যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন চমক! সৈন্যদের বাঁচাতে ইউক্রেনের কৌশল!

যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের সুরক্ষায় ইউক্রেন ব্যবহার করছে দূর নিয়ন্ত্রিত যান।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সাথে সাথে, প্রাণঘাতী রুশ ড্রোন হামলার মোকাবিলায় ইউক্রেনীয় সেনারা ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য ক্রমশ নির্ভর করছে দূর নিয়ন্ত্রিত সাঁজোয়া যানের ওপর।

এই যানগুলো দেখতে অনেকটা ছোট আকারের ট্যাঙ্কের মতো, যা সেনাদের জন্য রসদ সরবরাহ করা, মাইন অপসারণ করা এবং আহত সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার মতো কাজগুলো করে থাকে।

যুদ্ধ দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকায় এবং সেনা ঘাটতি দেখা দেওয়ায় ইউক্রেনীয় বাহিনী এইসব ‘চাকাওয়ালা রোবট’ মোতায়েন করতে আগ্রহী।

এই বিষয়ে ২০তম লিয়ুবার্ট ব্রিগেডের একটি প্লাটুন কমান্ডার, যিনি ‘মিয়ামি’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেন, তিনি বলেন, “এগুলো সম্পূর্ণরূপে মানুষের বিকল্প হতে পারে না।

তবে আমি বলব, যেখানে মানুষের যাওয়াটা খুব বিপজ্জনক, সেখানে এই যানগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।”

সাধারণত ইউক্রেনীয় কোম্পানিগুলোই এই সামরিক যানগুলো তৈরি করে।

তাদের আকার ও সক্ষমতা অনুসারে একেকটির দাম ১,০০০ মার্কিন ডলার থেকে ৬৪,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে (প্রায় ১,১০,০০০ টাকা থেকে ৭০,৪০,০০০ টাকা)।

যদিও এই ধরনের যান যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী ‘গোলিয়াথ’ নামের তারযুক্ত দূর নিয়ন্ত্রিত ছোট ট্যাংক ব্যবহার করেছিল।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ফেলো বেন ব্যারি’র মতে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য এবং চীনও যুদ্ধের জন্য আধুনিক সংস্করণ তৈরি করেছে।

তবে ইউক্রেনের এই যানগুলোর ব্যাপক ব্যবহার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এবং এটি প্রযুক্তির আরও উন্নতি ঘটাতে পারে।

রাশিয়াও দূর নিয়ন্ত্রিত যান ব্যবহার করে থাকে।

ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের শুরুতেই মিয়ামি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

প্রথমে তিনি পদাতিক এবং পরে ড্রোন চালক হিসেবে কাজ করেছেন।

যুদ্ধের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার কাজের ধরনও বদলেছে।

“আমি কখনো ভাবিনি যে আমি একজন ড্রোন চালক হব।

তবে যুদ্ধ মানেই অগ্রগতি, আর আমরা তো পিছিয়ে থাকতে পারি না।”

মিয়ামির দল যে রোবোটিক যানগুলো ব্যবহার করে, সেগুলো হয় চাকার ওপর চলে, না হয় ট্র্যাকযুক্ত থাকে।

এগুলোতে সামরিক রঙের প্রলেপ দেওয়া থাকে।

ধ্বংসস্তূপ অথবা মাটির রাস্তা দিয়ে এগুলো ধীরে ধীরে চলতে পারে, যা সৈন্যদের জন্য কঠিন বা বিপজ্জনক হতে পারে।

মিয়ামি আরও জানান, “আমরা এইসব যানকে উন্নত করছি।

রাশিয়ার ইলেকট্রনিক যুদ্ধের মোকাবিলায় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ আরও ভালোভাবে করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়।”

বর্তমানে মিয়ামির ১০ সদস্যের একটি দল এইসব যন্ত্রকে তাদের মিশনে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেছে।

প্রধানত তারা সৈন্যদের কাছে খাদ্য ও গোলাবারুদ পৌঁছে দেওয়ার কাজে এগুলো ব্যবহার করছে।

মিয়ামির দলের ‘আকিম’ নামের একজন সৈনিক জানিয়েছেন, দূরনিয়ন্ত্রিত বা প্রথম-ব্যক্তি ভিউ (এফপিভি) ড্রোন-এর মতোই এই যানগুলোর ব্যবহারও ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

“যখন এফপিভি ড্রোন প্রথম আসে, তখন এটি তেমন জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু যারা এটির পথপ্রদর্শক ছিল, তারাই এখন ভালো ফল দেখাচ্ছে।”

আকিম আরও জানান, এই স্ব-নিয়ন্ত্রিত যানগুলো ক্লান্ত হয় না।

একটি ড্রোন ব্যবহার করে তিনি আগে ওই এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

এরপর তিনি যানটিকে সামনের দিকে পাঠান।

কোন্সতান্তিনিভকা শহরের কাছাকাছি একটি বেসমেন্ট থেকে কাজ করা আকিম মাঝে মাঝেই বোমা হামলার শব্দ, কামানের আওয়াজ এবং ড্রোনের ভোঁ-ভোঁ শব্দ শুনতে পান।

একসময় ৬৭,০০০ মানুষের বসবাস করা কোন্সতান্তিনিভকা শহরটি এখন প্রায় জনশূন্য।

বাখমুতের কাছে ইউক্রেনের দখলে থাকা একটি ছোট এলাকার এটি।

শহরটির তিন দিক রুশ বাহিনীর দ্বারা প্রায় ঘেরাও করা হয়েছে।

এখানকার বাড়িগুলো বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখনো সেখানে ধোঁয়া উড়ছে।

আকাশ পথে ড্রোন ব্যবহারের ফলে আকিম নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে না ফেলে শহর এবং রাস্তাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

আকিম বলেন, “ড্রোন বা রোবট যখন কোনো কাজ করে, তখন এর মানে হলো আমাদের একজন যোদ্ধাকে সেই কাজটি করতে হচ্ছে না।

উপরন্তু, মেশিনটি কখনো ক্লান্ত হয় না।

এটি প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক কিছু বহন করতে পারে।”

সম্প্রতি, আকিমের দল এই যানগুলোতে ২০০ কিলোগ্রাম (৪৪0 পাউন্ড) ওজনের গোলাবারুদ, জ্বালানি, জল এবং খাদ্য বোঝাই করে সামনের দিকে কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকা ড্রোন অপারেটরদের কাছে পাঠিয়েছে।

যানটি ঘণ্টায় প্রায় ৬ কিলোমিটার বেগে চলে এবং একটি গোপন স্থানে তাদের মাল পৌঁছে দিয়ে নিরাপদে ফিরে আসে।

তবে, এই যানগুলো সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

কারণ এগুলো গাড়ি বা ট্রাকের চেয়ে ধীর গতিতে চলে এবং খোলা জায়গায় ব্যবহার করা হয়।

মিয়ামি জানান, “এ কারণে আমরা আহত সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই যানগুলো ব্যবহার করিনি।

কারণ এতে বিপদ থাকে।”

যানগুলোর দামও একটি বিষয়।

তার প্লাটুনের ব্যবহৃত যানগুলোর প্রতিটির গড় মূল্য প্রায় ৯,৭০০ মার্কিন ডলার (প্রায় ১০ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা)।

মিয়ামি বলেন, “দাম খুব বেশি না হলেও, যদি এক সপ্তাহে তিনটি বা চারটি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে খরচটা অনেক বেড়ে যায়।”

যানগুলোকে আরও সুরক্ষিত করতে মিয়ামি ও তার সেনারা সেগুলোর চারপাশে লোহার খাঁচা তৈরি করেছেন এবং সামনে মাইন শনাক্ত করার জন্য ধাতব রোলার লাগিয়েছেন।

যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে তারা নতুন মডেল তৈরি করছেন।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *