যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে ক্যাথলিক বিচারপতিদের প্রভাব : সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধর্ম কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী বিচারপতির সংখ্যাধিক্য নিয়ে একটি নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। কিভাবে এই বিচারপতিদের ধর্মীয় বিশ্বাস আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করে, তা এখন অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। সম্প্রতি প্রকাশিত বিচারপতিদের লেখা কিছু বই এবং তাদের দেওয়া রায় এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বিচারপতি অ্যান্টনি কেনেডি ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর একটি বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, গর্ভপাতের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে রায় দেওয়ার সময় তিনি কিভাবে তাঁর ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। বিচারপতি কেনেডি জানিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই জীবনের সুরক্ষা চেয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার দেওয়া হয়েছে কিনা, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি দ্বিধায় ছিলেন।
১৯৯২ সালের ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসি’ মামলার রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি কেনেডি’র এই দ্বিধা আরও বাড়ে। এই মামলায় ১৯৭৩ সালের ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায় বহাল রাখা হবে কিনা, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল। ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায়ে গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বিচারপতি কেনেডি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “আমি তখন প্রায়ই ভাবতাম, এই ধরনের একটি রায়ের সঙ্গে নিজেকে কিভাবে যুক্ত করব, যা আমার নৈতিকতার সঙ্গে মেলে না।
বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট, যিনি রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত, ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় ছিল, যেখানে তিনি গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করার পক্ষে মত দেন। এই রায়ের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন, কিভাবে একজন বিচারকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিচারপতিদের এই ধরনের সিদ্ধান্ত এবং তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত এখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ, দেশটির বিভিন্ন স্থানে খ্রিষ্টীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে এবং ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিদের ধর্ম কিভাবে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার আইন বিভাগের অধ্যাপক ডগলাস লেয়াকক মনে করেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জানতে চায়, বিচারপতিদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস তাঁদের রায়কে প্রভাবিত করে কিনা। তিনি আরও যোগ করেন, “বিচারকদের এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় তাঁদের গভীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল।
বিচারপতি কেনেডি এবং ব্যারেট উভয়েই তাঁদের ক্যাথলিক ধর্মকে তাঁদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে, তাঁদের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত ক্যাথলিক চার্চের নীতির সঙ্গে সরাসরি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, সমকামীদের অধিকারের প্রশ্নে বিচারপতি কেনেডি’র দেওয়া রায় নিয়ে তাঁর এবং বিচারপতি আন্তোইনin স্কালিয়ার মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। বিচারপতি স্কালিয়া ছিলেন রক্ষণশীল এবং তিনিও ক্যাথলিক ছিলেন।
অন্যদিকে, বিচারপতি উইলিয়াম ব্রেনান, যিনি ছিলেন উদারপন্থী, ১৯৭৩ সালের ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায়ে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে গর্ভপাত সমর্থন করি না। তবে, যাঁরা এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, তাঁদের অধিকার রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে ৬ জন বিচারপতি হয় ক্যাথলিক (প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস, ক্লারেন্স থমাস, স্যামুয়েল আলিতো, ব্রেট কাভানাফ এবং ব্যারেট) অথবা ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে ওঠা (নেইল গোরসাচ)। এদের মধ্যে বিচারপতি আলিতো তাঁর ধর্মীয় views নিয়ে বেশ সোচ্চার।
বিচারপতি ব্যারেট তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ২০১৭ সালে সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির শুনানিতে তাঁর ক্যাথলিক ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ডেমোক্রেট সিনেটর ডিয়ান ফাইনস্টাইন তাঁর একটি লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, “আপনার মধ্যে ধর্ম এত গভীরভাবে প্রোথিত, যা উদ্বেগের কারণ।
ব্যারেট আরও বলেন, “যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের পক্ষে আইনের চেয়ে নৈতিকতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া কঠিন। তবে, অন্যান্য বিচারকেরাও তাঁদের ব্যক্তিগত নৈতিকতার সঙ্গে আইনের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নাস্তিক যদি মনে করেন গর্ভপাতের অধিকার থাকা উচিত, তাহলে তাঁকে সেই বিষয়ে নিজের ব্যক্তিগত মতকে পাশে সরিয়ে রাখতে হয়।
এক্ষেত্রে বিচারকদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আইনের মধ্যেকার এই সম্পর্ক বেশ জটিল। বিচারপতি ব্যারেট তাঁর মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার অর্থ হলো, প্রতিটি মামলার রায় দেওয়ার সময় আইনের প্রতি অবিচল থাকা।
বিচারপতিদের এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো একদিকে যেমন তাঁদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে, তেমনিভাবে আইনের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতাকে তুলে ধরে। এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: সিএনএন