তুরস্কে এক প্রাচীন শহর, যা জয় করতে পারেননি দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: টার্মেসোসের অজানা কাহিনী
ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত তুরস্ক, যা শুধু তার সুন্দর সমুদ্র সৈকত আর ঐতিহাসিক স্থাপত্যের জন্যেই পরিচিত নয়, বরং লুকিয়ে আছে এক বিশাল ইতিহাসের ভান্ডার। তেমনই এক বিস্ময়কর স্থান হল টার্মেসোস।
দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এই প্রাচীন শহর, যা এক সময়ে ছিল দুর্ভেদ্য এক ঈগলের বাসা। ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও এই শহর জয় করতে পারেননি।
আজও, যারা তুরস্কের আন্তালিয়া শহর থেকে এখানে ভ্রমণ করেন, তারা এই শহরের ধ্বংসাবশেষের সাক্ষী থাকতে পারেন। তবে পর্যটকদের আনাগোনা এখানে খুব কমই দেখা যায়।
পাহাড়ের উপরে, নির্জনতায় আজও যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই শহর।
টার্মেসোস এক অসাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এখানকার পরিবেশ, ইতিহাস আর প্রকৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন রয়েছে।
বিশাল সমাধিসৌধ, বিশাল আকারের ভূগর্ভস্থ জলধার, মন্দির, দুর্ভেদ্য প্রাচীর এবং পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এক অত্যাশ্চর্য থিয়েটার, যা অনেকটা মাচু পিচু-র মত, এখানকার প্রধান আকর্ষণ।
আন্তালিয়ার কোলাহলপূর্ণ শহর থেকে গাড়িতে প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছানো যায় গুইলুক-টার্মেসোস জাতীয় উদ্যানের প্রবেশমুখে। এখানে পার্কের প্রবেশ ফি হিসেবে প্রায় ৩০০ টাকার মত লাগে।
এরপর পাইন আর ঝোপঝাড় ঘেরা পাহাড়ি পথে আরও ১০ মিনিটের যাত্রা।
শহরের প্রবেশমুখে রয়েছে এক বিশাল “আগোরা” বা বাজার, যেখানে একসময় ব্যবসায়ীরা কেনাবেচা করত। টার্মেসোসের আসল আকর্ষণ যেন এখানেই লুকিয়ে আছে।
পাথরের সারিবদ্ধ সমাধিগুলি যেন সেই অতীতের গল্প বলে।
প্রাচীনকালে নির্মিত সমাধিস্থলগুলোতে যাদের সমাধি ছিল, তাদের পরিচয় বহনকারী বিভিন্ন প্রতীক খোদাই করা আছে। কিছু সমাধির উপরে যোদ্ধাদের প্রতীক হিসেবে ঢাল ও বর্শা দেখা যায়।
কালের বিবর্তনে অনেক সমাধিরই ক্ষতি হয়েছে, যা আজও চোখে পড়ে।
স্থানীয় গাইড ও শিল্পী ওন্দার উগুর জানান, “এখানে যারা কাজ করত, তারা তাদের কাজে খুবই দক্ষ ছিল।” ১৯৯৬ সালে প্রথমবার এখানে আসার পর থেকেই তিনি এই শহরের প্রেমে পড়েন।
শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে কিছুটা পাহাড়ি পথে হাঁটতে হয়। এখানে আসার জন্য উপযুক্ত জুতো এবং শারীরিক সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।
গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে, সকালের দিকে ভ্রমণ করা ভালো।
প্রাচীন শহরের দিকে যেতে চোখে পড়ে এখানকার সুরক্ষিত দেওয়াল। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে এই শহরটি তৈরি করা হয়েছিল।
প্রশ্ন জাগে, কীভাবে টার্মেসোসের মানুষ এই বিশাল কাজগুলো সম্পন্ন করেছিল?
ওন্দার উগুরের মতে, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের দক্ষতা উপলব্ধি করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, “কম্পিউটার আর সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আমরা অসহায়, কিন্তু তাদের (প্রাচীন যুগের মানুষ) কিছুই ছিল না। পাথর দিয়ে কাজ করাই ছিল তাদের জীবনের অংশ।”
টার্মেসোসের বাসিন্দারা “সোলিমস” নামে পরিচিত ছিল। তারা ছিল লুভিয়ানদের বংশধর। লুভিয়ানরা ছিল এক প্রাচীন সভ্যতা, যারা একসময় আজকের তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করত।
যদিও তাদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, কৌশলগত কারণে তারা এই স্থানটি বেছে নিয়েছিল।
কারণ, এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথের উপরে, যা তাদের প্রচুর সম্পদ এনে দিয়েছিল। এছাড়াও, এর উঁচু অবস্থান শহরটিকে প্রতিরক্ষার দিক থেকেও শক্তিশালী করেছিল।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যখন এখানে আক্রমণ করতে আসেন, তখন টার্মেসোসকে জয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। আলেকজান্ডার এই শহরকে “ঈগলের বাসা” হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
পরবর্তীকালে রোমানরা যদিও এই শহরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে, তবে তা যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, বরং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে।
পাহাড়ের উপরে, শহরের পুরনো একটি জিমনেসিয়ামের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এখানে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
এই জিমনেসিয়ামের সামনে ছিল কুস্তি এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণের স্থান। সম্ভবত ভূমিকম্পের কারণে টার্মেসোসের পতন হয়।
২০২৫ সাল থেকে এখানে খনন কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এই খনন কার্যের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাধিসৌধ, নেক্রোপলিস রাস্তা, প্রাচীন জল কাঠামো এবং হ্যাড্রিয়ানের গেট পুনরুদ্ধার করা।
ওন্দার উগুর এই শহরের সৌন্দর্য আর নির্জনতা উপভোগ করেন। তিনি বলেন, “এখানে প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন