চায়নাটাউনের অলিগলিতে ক্যামেরাবন্দী এক বিস্ময়কর যাত্রা!

চীনের সংস্কৃতি আর অভিবাসনের এক উজ্জ্বল চিত্র, ক্যামেরাবন্দী করেছেন মরিস লুম। উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা চায়নাটাউনগুলোতে (China Town) ঘুরে ছবি তুলেছেন তিনি, যেখানে সময়ের সাথে সাথে বদল এসেছে জীবনযাত্রায়, ব্যবসায়িক কাঠামোয়।

এই ছবিগুলো যেন এক একটি জীবন্ত দলিল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা অভিবাসী জীবনের গল্প বলে।

কানাডা এবং আমেরিকার বিভিন্ন শহরের চায়নাটাউনে (China Town) ঘুরে ছবি তুলেছেন মরিস লুম। তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, কিভাবে সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে এই জনপদগুলো।

কখনো রেস্টুরেন্টের মেনু বদলাচ্ছে, আবার কখনো দোকানের রংচঙে সাইনবোর্ডগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, কারণ ব্যবসার মালিকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের অনাগ্রহের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। লুমের ভাষায়, “এটাই চায়নাটাউনের জীবনচক্র।”

টরন্টোতে (Toronto) বসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লুম জানান, তিনি আসলে চায়নাটাউনগুলোর একটি ‘রেকর্ড’ রাখতে চেয়েছিলেন। তার তোলা ছবিগুলোতে অভিবাসন এবং জনসংখ্যার পরিবর্তনের চিত্র ফুটে উঠেছে।

উদাহরণস্বরূপ, ফিলাডেলফিয়ার (Philadelphia) একটি ছবিতে দেখা যায়, একসময়ের জনপ্রিয় একটি খাবারের দোকানের জায়গায় এখন তৈরি হয়েছে ‘কে-বিউটি’ নামের একটি নতুন দোকান। এটি যেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসাধনী সামগ্রীর ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রমাণ।

আবার কোথাও পুরনো ব্যবসার জায়গায় নতুন করে চীনা অক্ষর খোদাই করা সাইনবোর্ড দেখা যায়, যা মূল চীন থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

লুমের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, কিভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। নিউইয়র্কের (New York) ‘নিউ গোল্ডেন ফং ওং বেকারি’ (New Golden Fung Wong Bakery) ৬০ বছর ব্যবসা করার পর বন্ধ হয়ে যায়, আবার ভ্যাঙ্কুভারের (Vancouver) ‘হো সান হিং প্রিন্টার্স’ (Ho Sun Hing Printers) এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ব্যবসা করার পর ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায়।

চায়নাটাউনগুলোর (China Town) পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো জেন্ট্রিফিকেশন বা ধনী শ্রেণীর মানুষের আগমন। একসময় বন্দর বা জনবহুল এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় চায়নাটাউনগুলো (China Town) ব্যবসার জন্য উপযুক্ত ছিল।

কিন্তু এখন সেই জায়গাগুলোর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় পুরনো ব্যবসায়ীরা সেখানে টিকে থাকতে পারছেন না। টরন্টোর (Toronto) একটি অগ্নিকাণ্ডের পর খালি হওয়া একটি জায়গায় ম্যাকডোনাল্ডস (McDonald’s) আসার কথা শুনে লুম বলেছিলেন, “এটা চায়নাটাউনের (China Town) পরিবর্তনশীলতার একটি বড় উদাহরণ।”

কোভিড-১৯ (COVID-19) মহামারীর সময়ে চায়নাটাউনগুলোর (China Town) ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। লেখক ও শিক্ষাবিদ লিলি চোর মতে, চীনের উহান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ বেড়ে গিয়েছিল, যা এই জনপদগুলোকে আশ্রয়স্থল এবং একইসঙ্গে সহিংসতার স্থানে পরিণত করেছিল।

লুমের জন্ম ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে। তার বাবা ছিলেন চীনা বংশোদ্ভূত এবং মা ছিলেন ম্যাকাওয়ের বাসিন্দা।

১৯৮০-এর দশকে পরিবারসহ তিনি কানাডায় পাড়ি জমান। শৈশবে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরের চায়নাটাউনে (China Town) যেতেন।

সেখানে তারা চাইনিজ খাবার খেতেন এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেন। লুমের বাবা-মায়ের কাছে সেই চায়নাটাউন (China Town) ছিল পরিচিত একটি জগৎ, যা তাদের অভিবাসী জীবনে স্বস্তি এনে দিত।

লুমের ছবিগুলোতে পুরনো দিনের ব্যবসার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের আগ্রহও ফুটে উঠেছে। সান ফ্রান্সিসকোর (San Francisco) ‘লি পো ককটেলস’ (Li Po Cocktails) এবং এডমন্টনের (Edmonton) ‘দ্য লিংনান’ (The Lingnan)-এর মতো পুরনো ব্যবসাগুলো এখনো টিকে আছে।

আবার, ওকল্যান্ডের (Oakland) ‘ইউয়েন হপ নুডল কোম্পানি’র (Yuen Hop Noodle Company) মতো কিছু ব্যবসা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের প্রসারিত করেছে। লুম মনে করেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চায়নাটাউনে (China Town) ব্যবসা করার আগ্রহ বাড়ছে, যা তাদের পরিচিত পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।

মরিস লুমের তোলা ছবিগুলো নিয়ে “চায়নাটাউনস: টং ইয়ান গাই” (Chinatowns: Tong Yan Gaai) নামে একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, যা আগামী ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে বাজারে আসবে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *