বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন জনপ্রিয় মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী টেইলর সুইফট। তবে শুধু গান গেয়েই নন, বরং একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তার বিশাল সাম্রাজ্য এখন শুধু গানের অ্যালবাম বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে, যা ক্যাসেট বিক্রি থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্প্রতি প্রকাশিত তার দ্বাদশ স্টুডিও অ্যালবাম ‘দ্য লাইফ অফ আ শোগার্ল’ এবং কনসার্ট ফিল্ম উভয়ই ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।
ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার ইনডেক্স-এর হিসাব অনুযায়ী, বাজারের পরিবর্তন, রেকর্ড-ব্রেকিং ‘এরাস ট্যুর’ এবং কনসার্ট মুভি থেকে অর্জিত অর্থ, সেইসঙ্গে তার পুরনো অ্যালবামগুলোর স্বত্ব কিনে নেওয়ার কারণে গত দুই বছরে সুইফটের সম্পদের পরিমাণ আরও এক বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
বর্তমানে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২.১ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি)।
সাধারণ সেলিব্রিটিদের থেকে ভিন্ন, সুইফট তার ব্যবসার কৌশলকে নিজের পরিচিতির অংশ করে তুলেছেন। সংগীত জগতে এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাদের উপার্জনের সিংহভাগ আসে প্রযোজক বা অন্যান্য কর্মকর্তাদের হাত ধরে।
কিন্তু টেইলর সুইফট এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘আমি এটা হতে দেব না, আমি এই ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তন আনব।’ ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগনের অধ্যাপক ড্রিউ নোবিলের মতে, এই কারণেই ‘সুইফটনমিক্স’-এর ধারণা তৈরি হয়েছে।
সুইফটের সর্বশেষ কনসার্ট মুভি ‘টেইলর সুইফট: দ্য এরাস ট্যুর’ মুক্তি পাওয়ার পর সিনেমা হলগুলোতে দর্শক উপস্থিতি বেড়ে যায়। বিশ্বজুড়ে সিনেমাটি ২৬১.৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
সিনেমাটির পরিবেশক সংস্থা এএমসি জানায়, মুক্তির প্রথম দিনেই অগ্রিম টিকিট বিক্রির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে সিনেমাটি। এমনকি ‘স্পাইডার-ম্যান: নো ওয়ে হোম’-এর রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে এটি।
শুধু তাই নয়, সিনেমা হল থেকে লাভের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুইফট সরাসরি এএমসির সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি সিনেমার লাভের একটি বড় অংশ পান।
বর্তমানে তিনি ‘টেইলর সুইফট: দ্য অফিশিয়াল রিলিজ পার্টি অফ আ শোগার্ল’ নামে আরেকটি এএমসি পরিবেশিত সিনেমার কাজ করছেন, যা তার নতুন অ্যালবামের মুক্তি উপলক্ষে তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সিনেমাটি মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করবে।
সুইফটের ‘এরাস ট্যুর’ ছিল সর্বকালের সবচেয়ে বেশি আয় করা সফর। শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকায় টিকিট বিক্রি থেকে এর আয় ছিল ২.২ বিলিয়ন ডলার।
এই সফরের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ খরচ করেছেন ভক্তরা। এর মধ্যে ভ্রমণ, হোটেল, খাবার ও বিভিন্ন পণ্যের পেছনে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন।
সুইফটের কনসার্টগুলো যে শহরগুলোতে হয়েছে, সেখানকার দোকানগুলোতেও বেচাকেনা বেড়েছে। এমনকি হোটেলগুলোতেও রেকর্ড সংখ্যক বুকিং হয়েছে।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কারার মতে, সুইফটের অ্যালবাম অন্যান্য শিল্পীর তুলনায় স্থানীয় পর্যায়ে বেশি অর্থ সরবরাহ করে। এর ফলস্বরূপ, মুক্তি উপলক্ষে আয়োজিত পার্টিগুলোতে বারের ব্যবসা বাড়ে, ভক্তরা নতুন পোশাক কেনেন এবং সিনেমা হলের টিকিট বিক্রিও বাড়ে।
২০১৯ সাল থেকে সুইফটের গানের স্বত্ব থেকে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুরনো অ্যালবামগুলোর মাস্টার রেকর্ডিংয়ের স্বত্ব কিনে নেওয়ার ফলে এখন তিনি তার পুরো গানের ক্যাটালগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা তার আয়ের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবে।
সুইফটের অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার পর তার পুরনো গানগুলোর স্ট্রিমিংও বাড়ে, যা নিশ্চিতভাবে তার আয় আরও বাড়াতে সাহায্য করবে। বর্তমানে, স্পটিফাই-এ গত দুই বছর ধরে শীর্ষ শিল্পী তিনিই।
তার অ্যালবামগুলো একশোরও বেশি বার প্লাটিনাম হয়েছে, অর্থাৎ প্রতিটি অ্যালবাম এক মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
বর্তমানে গানের অ্যালবাম বিক্রিই শিল্পীদের আয়ের প্রধান উৎস নয়। স্ট্রিমিং-এর এই যুগে সুইফট নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
তিনি তার নতুন অ্যালবামকে মার্চেন্ডাইজ, কালেক্টেবল ভিনাইল ও ক্যাসেট সংস্করণ, ট্যুর এবং সিনেমার মতো ‘কুটির শিল্প’ তৈরি করার মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। অধ্যাপক নোবিলের মতে, এখনকার ব্যবসা শুধু অ্যালবাম বিক্রি কিংবা টিকিট বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক কাঠামো।
সুইফটের এই সাফল্যের ধারা বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। কপিরাইট বিষয়ক জটিলতা, আয়ের নতুন উৎস তৈরি এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সুইফটের কৌশল অনুসরণ করে বাংলাদেশের শিল্পীরাও লাভবান হতে পারেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন