মায়ানমারে ত্রাণ বন্ধ: শিশুদের আর্তনাদ, ক্ষুধার যন্ত্রণায় মৃত্যু

মিয়ানমারে মার্কিন সহায়তা হ্রাস: খাদ্য সংকটে শিশুদের আর্তনাদ, মানবিক বিপর্যয়

মিয়ানমারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা কমানোর ফলে দেশটির রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ বিভিন্ন দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। খাদ্যের অভাবে শিশুদের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, যা মানবিক বিপর্যয়ের এক ভয়াবহ চিত্র। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার মানুষগুলো খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা হ্রাস করার সিদ্ধান্তের কারণে সেখানকার মানুষগুলো খাদ্য সংকটে পড়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে মিয়ানমারের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। একসময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ইউএসএআইডি (USAID) ভেঙে দেয়ার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ‘দ্য ল্যান্সেট’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, মার্কিন সাহায্য কমানোর ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ ১৪ মিলিয়নের বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যার মধ্যে ৫০ লাখের বেশি শিশু রয়েছে।

রাখাইন রাজ্যে, যেখানে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ বন্দীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে, সেখানকার পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্য, যাদের ওপর ২০১৭ সালে দেশটির সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালায়। সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাদের খাবারের পরিমাণ কমে গেছে, যেখানে আগে তারা দিনে তিন বেলা খেত, এখন সেখানে এক বেলা খাবার জোটে কিনা সন্দেহ।

মোহাম্মদ তাহের নামের এক ব্যক্তি জানান, সাহায্য বন্ধ হওয়ার কারণে তিনি তার ২ বছর বয়সী ছেলেকে হারিয়েছেন। তার মতে, শুধুমাত্র তিনিই নন, আরও অনেক শিশু অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে।

এমনই একজন প্রতিবেশী মোহাম্মদ ফয়াস। তিনি জানান, শিশুর মৃত্যুর পর তিনি পরিবারটিকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং দাফনেও অংশ নিয়েছিলেন। তাহের এর মতে, এই অবস্থার জন্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। তাদের শিবিরে জীবনধারণের একমাত্র উপায় ছিল ত্রাণ। ত্রাণ না থাকায় তাদের কাছে খাবার, ওষুধ বা বাঁচার কোনো সুযোগ নেই।

মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতেও একই অবস্থা। সেখানকার শিশুরা খাবারের জন্য চিৎকার করছে। স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে, এবং অনেককে খাবার সংগ্রহের জন্য দিনের পর দিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। সহিংসতা ও চুরির ঘটনাও বেড়েছে। অনেকে ক্ষুধার জ্বালা কমাতে আঠা (গ্লু) পান করছে।

এই সংকট মোকাবিলায় সাহায্য সংস্থাগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে এবং অনেক কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ফ্রিডম হাউজের একটি জরুরি সহায়তা প্রকল্পের প্রধান ভিক্টর জানান, সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় ১০০ জন সাধারণ মানুষ সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানালেও, তিনি তাদের কোনো সাহায্য করতে পারছেন না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ বৈদেশিক খাতে খরচ করে, তবে ট্রাম্প প্রশাসন ইউএসএআইডিকে অর্থের অপচয় হিসেবে বর্ণনা করে তা বিলুপ্ত করে দেয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Food Program) এপ্রিল মাস থেকে মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে খাদ্য নিরাপত্তা কমে গেছে, যেখানে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৩৩ শতাংশ পরিবার খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারতো না, বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে ৫৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট টুন খিন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই সাহায্য কর্তন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার একটি কৌশল হিসেবে কাজ করছে।

সাহায্য হ্রাস এমন এক সময়ে এসেছে, যখন মিয়ানমার কঠিন সময় পার করছে। ভূমিকম্পের কারণে যখন ৩ হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়, তখনও যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠাতে পারেনি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র “বার্মার জনগণের পাশে আছে”, তবে তারা আশা করে, সক্ষম দেশগুলো তাদের সহায়তা বাড়াবে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মিয়ানমারের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাইকেল ডানফোর্ড এপ্রিল মাসে রাখাইন সফর করেন এবং সেখানকার পরিস্থিতি দেখে মর্মাহত হন। তিনি জানান, কিছু মা তাদের শিশুদের ঘাস থেকে তৈরি করা তরকারি খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন।

“এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা এবং কোনো আশার আলো নেই,” – এমনটাই জানান ডানফোর্ড।

খাদ্যের অভাবে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মোহাম্মদ ইলিয়াস নামের এক ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। তার ছেলে মোহাম্মদ আমিন জানান, তাদের পরিবার দিনে একবার ভাত ও শাকসবজি খেয়ে দিন কাটাতো।

শরণার্থী শিবিরে ১২ বছর বয়সী মোহামা, বৃষ্টির মধ্যে কাদায় বসে পোকামাকড় ধরে তার পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করার চেষ্টা করছে। ক্ষুধা ও কষ্টের শিকার হওয়া মিয়ানমারের শিশুরা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শিকার, যা তারা বুঝতে পারে না।

মোহামা ২০১৩ সালে তার পরিবারের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে সে তার দাদা-দাদি ও ভাইয়ের সঙ্গে একটি ছোট কুঁড়েঘরে বাস করে।

১১ বছর বয়সী সোয়েও ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে। অনেক সময় সে স্কুলে না খেয়েই যায়। শিক্ষিকা সাউং হনিন ওয়াই জানান, সাহায্য বন্ধ হওয়ার কারণে তার স্কুলের ১০ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, কারণ তাদের বাবা-মায়েরা স্কুলের ফি দিতে পারছেন না এবং তাদের উপার্জনের জন্য কাজে লাগাতে হচ্ছে।

শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী ৪৬ বছর বয়সী নাওং পাতে জানান, তার ৬ সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে না পেরে তিনি হতাশ। তিনি বলেন, “আমার সন্তানদের মাছের সঙ্গে শুধু ভাত আর কিছু সবজি খেতে দেখে আমার হৃদয় ভেঙে যায়।

শরণার্থীদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য পুনরায় চালু করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, যাতে মিয়ানমারের মানুষ এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পারে।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *