গাজায় যুদ্ধের ২ বছর: কান্না, ক্ষুধা আর ধ্বংসের ছবি!

গাজায় যুদ্ধের দুই বছর: ধ্বংসস্তূপ আর ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার।

গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরুর দুই বছর পার হয়েছে। এই সময়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটিতে মানুষের জীবনযাত্রা চরম বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে।

জাতিসংঘের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় অন্তত ৬৭,১৭৩ জন নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭80 জন আহত হয়েছেন। যুদ্ধের আগে গাজার প্রতি নয় জন মানুষের মধ্যে একজন হয় নিহত হয়েছেন, নয়তো আহত হয়েছেন।

সেখানকার অধিবাসীদের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুঃখ আর দুর্দশা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় এখন খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা মানবিক বিপর্যয় আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

এখানকার অধিকাংশ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, কাজ হারিয়েছেন এবং স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে চলে গেছেন। মিশর-সহ অন্যান্য দেশের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোচনা চললেও, গাজার মানুষের মনে শান্তি ফেরার কোনো লক্ষণ নেই।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস এবং তাদের মিত্রদের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। হামাসের হামলায় ১,২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে বন্দী করা হয়।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা, এমনকি গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যরাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ এনেছেন। যদিও ইসরায়েল সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

গাজার মানুষের জীবন এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। তারা তাদের প্রিয়জনদের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন।

সেখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো।

মাহমুদ নাবিল ফরাজ নামের এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরে তার পরিবার দিনে একবার খাবার খাচ্ছে। অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়, কারণ তিনি চান তার ৭ বছর বয়সী ছেলে ও ৫ বছর বয়সী মেয়ে যেন অন্তত কিছু খেতে পারে।

তিনি বলেন, “আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার নেই। শরীরে দুর্বলতা বাড়ছে। খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট চলছে। ফল তো নেই-ই, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার পাওয়া যায় না। ডিমও নেই। মাংস বা মুরগি পাওয়া যায় না।”

নিয়মিত কম খাওয়ার কারণে তার মাথা ঘোরাচ্ছে বলেও জানান তিনি। সেখানকার বাজারের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “খাবারের দাম আকাশছোঁয়া।

একটি কেজি চিনি এখন ১৫০ ডলারে (প্রায় ১৬,৫০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। কিভাবে আমরা এক বেলা খাবার জোগাড় করি, সৃষ্টিকর্তাই জানেন।” ফরাজ আরও জানান, যুদ্ধের আগে গাজা সিটির শুজাইয়াতে তার একটি মুদি দোকান ছিল এবং তার স্ত্রীর একটি চক্ষু চিকিৎসার কেন্দ্র ছিল।

ইসরায়েলি হামলায় সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের বাড়িও বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

রাঘাদ ইজ্জাত হামাউদা নামের এক তরুণীর চোখেমুখেও উদ্বেগের ছাপ। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্ষুধার্ত ও অপুষ্টিতে ভুগছেন।

তার ছয় ছোট ভাইবোনের কথা ভেবে তিনি সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “তাদের সুন্দর স্বপ্ন ছিল— ভবিষ্যতে তারা ভালো স্কুলে পড়বে, বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যাবে, ভালো ফল করবে।

কিন্তু আজ তাদের একমাত্র স্বপ্ন হলো—জড়ো করা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো এবং খাবার পানি সংগ্রহ করা। এক টুকরো রুটি পেলে তারা খুশি হয়। এমন একটা জীবন কি কল্পনা করা যায়?”

রাঘাদের মা-বাবা প্রায়ই না খেয়ে থাকেন, যাতে ছেলেমেয়েরা খেতে পারে। রাঘাদ জানান, গাজার বাজারে ফল বা মাংস পাওয়া যায় না।

কিছু সবজি পাওয়া গেলেও, সেগুলোর দাম অনেক বেশি। তিনি বলেন, “যুদ্ধের আগে আমাদের পরিবারে নানা ধরনের খাবার ছিল।

কিন্তু এখন আমাদের একমাত্র খাবার হলো—ডিমের টিন, মটরশুঁটি, মাংস এবং শিমের টিন। এছাড়া ছোলা, মসুর ডাল ও শস্যদানা জাতীয় খাবার খাচ্ছি।” রাঘাদ আরও জানান, এই যুদ্ধে তিনি তার পরিবারের ১০ জন সদস্যকে হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে তার ৮০ বছর বয়সী দাদিও ছিলেন।

মোহাম্মদ সাঈদ আল-খতিব নামের আরেক ব্যক্তি জানান, যুদ্ধের কারণে তিনি তার শরীরের ওজন এক তৃতীয়াংশেরও বেশি হারিয়েছেন।

তার কথায়, “আমি আয়না দেখি না অনেক দিন, তাই নিজের চেহারা দেখে অবাক হয়েছিলাম। গাজার আল-জাহরা এলাকা একসময় খুবই সুন্দর ছিল, কিন্তু গত দুই বছরে ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় সেটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

আমার সন্তানদের জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে: স্কুল নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই, পর্যাপ্ত খাবার বা পরিষ্কার পানি নেই। তাদের চারপাশে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।”

মোহাম্মদ মাতার নামের এক ব্যক্তি জানান, যুদ্ধের আগে তিনি গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। তার পরিবারের খাবার ও পানীয়ের কোনো অভাব ছিল না। তারা নিয়মিত বাইরে ঘুরতে যেত।

যুদ্ধের কারণে সেই জীবন এখন সুদূর পরাহত। তিনি বলেন, “আমার সন্তানেরা অপুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে।

তাদের একজনের বয়স ৪ বছর, অন্যজনের ২ বছর। আমরা এক কেজি আটা কিনি, যা দিয়ে আড়াই দিন চালাতে হয়। কখনও কখনও আমি না খেয়ে ঘুমাই, যাতে আমার ছেলে সকালে স্কুলে যেতে পারে এবং অন্তত আধ-রুটি খেতে পারে।”

এভাবে গাজার প্রতিটি মানুষের জীবন যুদ্ধের বিভীষিকায় ক্ষত-বিক্ষত। খাবারের অভাবে শিশুদের স্বাস্থ্যহানি ঘটছে।

ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজার মানুষগুলো আজ শুধু ধ্বংসস্তূপের মাঝে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *