পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি (Male Gaze): আবারও কি ফিরছে সেই পুরোনো ধারণা?
বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং এর প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা হলেও, আমাদের দেশেও এর প্রাসঙ্গিকতা অনেক।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি (male gaze)-এর ধারণাটি আবারও আলোচনায় এসেছে, যা মূলত নারীদের প্রতি একজন পুরুষ দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে মিডিয়ায় চিত্রিত করার একটি প্রক্রিয়া।
এই ধারণার ফিরে আসা, সমাজের উপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তাই নিয়ে আজকের এই নিবন্ধ।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি (male gaze) আসলে কী? সোজা কথায়, মিডিয়াতে নারীদের উপস্থাপন করা হয় যেন তারা কেবল পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই তৈরি হয়েছে।
এই ধরনের উপস্থাপনায় নারীদের শরীর, সৌন্দর্য এবং তাদের ভূমিকা, সবই পুরুষের কামনা-বাসনার প্রতিফলন ঘটায়।
এই ধরনের উপস্থাপনা নারীকে দুর্বল, নির্ভরশীল এবং প্রায়ই যৌনতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে।
এই ধারণাটির সূত্রপাত হয় ১৯৭৫ সালে, যখন চলচ্চিত্র সমালোচক লরা মালভি তার একটি লেখায় এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
মালভি মূলত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নারীদের চিত্রায়নের সমালোচনা করেন, যেখানে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, গল্পের ধরন, সবকিছুই পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা হয়।
সময়ের সাথে সাথে, এই ধারণাটি সিনেমা, টেলিভিশন, ফ্যাশন, বিজ্ঞাপন এবং সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে নব্বই দশক থেকে নারীদের অধিকার এবং তাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।
কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, এবং মিডিয়াতেও নারীদের ইতিবাচক ও শক্তিশালী চরিত্রে উপস্থাপন করার প্রবণতা দেখা গেছে।
কিন্তু সম্প্রতি, এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা পুরনো ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড, যেমন আমেরিকান ঈগল (American Eagle), তাদের বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘পুরুষের দৃষ্টি’ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করছে।
এছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, শরীরচর্চা এবং সৌন্দর্যের নামে, পুরোনো ও সংকীর্ণ ধারণাকেই যেন পুনরায় সামনে আনছেন।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যদি বিষয়টি দেখি, তাহলে এই ধরনের প্রবণতাগুলো উদ্বেগের কারণ।
কারণ, পশ্চিমা বিশ্বের এই পরিবর্তনগুলো আমাদের সমাজে নানাভাবে প্রভাব ফেলে।
আমাদের দেশের মিডিয়াতেও নারীদের উপস্থাপন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
অনেক সময়, এখানেও নারীদের সৌন্দর্য, পোশাক এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করা হয়।
এর ফলস্বরূপ, সমাজে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে।
নারীরা নিজেদের দুর্বল ভাবতে শুরু করতে পারে, এবং তাদের অধিকারগুলো খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তবে, আশার আলোও দেখা যায়।
বর্তমানে, অনেক নির্মাতা এবং শিল্পী নারীদের গল্প বলার জন্য এগিয়ে আসছেন।
তারা নারীদের জীবন, তাদের সংগ্রাম এবং তাদের সাফল্যের কথা তুলে ধরছেন, যা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টির বিপরীতে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে।
এই ধরনের কাজগুলো সমাজে নারীদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে।
এই পরিস্থিতিতে, আমাদের সচেতন হতে হবে।
মিডিয়াতে নারীদের উপস্থাপন কেমন হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, এবং নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।
একইসাথে, আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
পশ্চিমা বিশ্বের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে, নিজেদের সমাজের জন্য উপযোগী একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি (male gaze) একটি জটিল বিষয়।
এর বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়।
তবে, সচেতনতা এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজে নারীদের জন্য একটি সুন্দর ও সম্মানজনক স্থান তৈরি করতে পারি।
তথ্যসূত্র: সিএনএন (CNN)