ট্রাম্পের বাকস্বাধীনতায় ‘ইউ-টার্ন’, আসল রহস্য কী?

ট্রাম্পের বাক-স্বাধীনতার ধারণার পরিবর্তন: একটি দীর্ঘ যাত্রার গল্প।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাক-স্বাধীনতা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। একসময় যিনি নিজেকে বাক-স্বাধীনতার একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, ক্ষমতায় আসার পর তার সেই অবস্থানে দেখা যায় ভিন্নতা। বিভিন্ন সময়ে তার নেওয়া কিছু পদক্ষেপ সেই দ্বিচারিতার প্রমাণ দেয়।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প প্রায়ই বলতেন, “যদি আমাদের বাক-স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য হতে পারি না।” কিন্তু ক্ষমতায় আসার ন’মাসের মধ্যেই তার বক্তব্যে মেলে ভিন্ন সুর। হোয়াইট হাউসে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছি।” মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়ানোকে কেন্দ্র করে দেওয়া এক মন্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি এমনটা বলেছিলেন। যদিও দেশটির সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট রায় রয়েছে যে, পতাকা পোড়ানো বাক-স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।

ট্রাম্পের এই অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। তার সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি করেছে। যেমন, ফিলিস্তিনিপন্থী শিক্ষাবিদদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য তার প্রশাসনের সমালোচনা করা হয়। এমনকি, এলজিবিটি রূপান্তর থেরাপি নিষিদ্ধ করার একটি আইনের বিরোধিতা করে রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এটি থেরাপিস্টদের বাক-স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করতে পারে। এছাড়াও, কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে কিভাবে কথা বলা হবে, সে বিষয়েও ট্রাম্প কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে চেয়েছিলেন, যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বাক-স্বাধীনতার বিষয়টি সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দেশটির সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। তবে, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই স্বাধীনতা সবসময় একইভাবে রক্ষা করা হয়নি। স্বাধীনতার শুরুতেই, জন অ্যাডামসের শাসনামলে, সরকার সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে।

ঐতিহাসিক ফারাহ দাবোওয়ালা মনে করেন, “শুরু থেকেই বাক-স্বাধীনতা একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।” বেনিয়ামিন ফ্রাঙ্কলিনের নাতিকে জন অ্যাডামসের সমালোচনা করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। এছাড়া, ম্যাথু লিয়ন নামের এক প্রকাশককে কারারুদ্ধ করা হয়, যিনি অ্যাডামসের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। তবে, এই দমন-পীড়নের ফল হয় উল্টো। লিয়ন জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকার সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে। ইউজিন ডেব্স নামের এক সমাজতান্ত্রিক নেতাকে যুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট তার সাজা বহাল রেখেছিল, কিন্তু ডেব্স জেল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রায় ১০ লক্ষ ভোট পান।

বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে আদালতেরও ভিন্নমত রয়েছে। বিচারপতি অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস যেমন ডেব্সের শাস্তিকে সমর্থন করেছিলেন, তেমনি তিনি আবার ভিন্ন একটি মামলায় ভিন্নমত পোষণ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে, বাক-স্বাধীনতার বিষয়টি জাতিগত ইস্যুগুলোর সঙ্গেও জড়িত। ১৮৩০-এর দশকে দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনকে দমন করা হয়েছিল। সেই সময়, যারা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লিখতেন, তাদের কারারুদ্ধ করা হতো। পরবর্তীকালে, নাগরিক অধিকার আন্দোলন বাক-স্বাধীনতাকে আরও সুসংহত করতে সাহায্য করেছে। তবে, বর্তমানে “বিদ্বেষমূলক বক্তব্য” (hate speech) নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রায়ই ইউরোপীয় দেশগুলোকে বাক-স্বাধীনতা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপ তাদের সেই কথার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

ফারাহ দাবোওয়ালার মতে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বাক-স্বাধীনতা হুমকির মুখে। তিনি মনে করেন, সরকার এখন এমন রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরকে দমন করতে চাইছে, যাদের সঙ্গে তারা একমত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংশোধনী সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে বাক-স্বাধীনতা রক্ষা করে, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। এই কারণে, অনেক সময় দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে কিছু প্রকাশ করার কারণে চাকরি হারাতে পারেন।

মিথ্যা তথ্য এবং ভুল তথ্যের বিস্তার বর্তমানে একটি বড় সমস্যা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দ্রুত মিথ্যা খবর ছড়িয়ে পরে। তবে, এই সমস্যা সমাধানে কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি কতটা কার্যকর, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

এক্ষেত্রে, সরকারের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, যাতে ভুয়া তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে না পরে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *