আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গবেষণা সহযোগিতা দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। বিভিন্ন দেশের গবেষকরা একসঙ্গে কাজ করে উদ্ভাবনী ধারণা তৈরি করেন, যা বিশ্বজুড়ে জ্ঞানচর্চাকে সমৃদ্ধ করে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার গবেষণা অংশীদারিত্ব নিয়ে সম্প্রতি নতুন কিছু উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক এখন এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে একদিকে যেমন পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনই জাতীয় নিরাপত্তা এবং স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা আশঙ্কা করছেন যে, চীন এই ‘উন্মুক্ত গবেষণা’ (Open Research) ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সামরিক প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করছে। তাদের মতে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বে আঘাত লাগতে পারে।
এই উদ্বেগের কারণ হিসেবে তারা চীনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মার্কিন গবেষকদের সহযোগিতা এবং তথ্য আদান-প্রদানকে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে, সিনেটর টম কটনসহ অনেকে গবেষণা সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিধি-নিষেধ আরোপের জন্য আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেছেন।
তাদের মূল লক্ষ্য হলো, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে যে গবেষণাগুলো সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাউজ সিলেক্ট কমিটি অন দ্য চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি’ (House Select Committee on the Chinese Communist Party) মনে করে, চীন এই ‘উন্মুক্ত গবেষণা’কে সামরিক আধুনিকীকরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে গবেষণা ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব চুরির অভিযোগও এনেছে।
এই পরিস্থিতিতে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান গভীর শিক্ষাগত সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে পড়েছে, যা কয়েক দশক ধরে চলে আসছিল। বাণিজ্য যুদ্ধ এবং শুল্কের কারণে এমনিতেই দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা এখন সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতার দিকে মোড় নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সেন্টারের পরিচালক জেমস ক্যাংগিয়ালোসি (James Cangialosi) বলেছেন, বিদেশি প্রতিপক্ষরা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান ‘উন্মুক্ত ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ’কে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে।
এমনকি, সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছিল। এই সহযোগিতার মাধ্যমে চীন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা সামরিক খাতে কাজে লাগছে।
তবে, এই পরিস্থিতিতে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, গবেষণা সহযোগিতায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভ্যাসার কলেজের সমাজবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সমাজের অধ্যাপক অ্যাবিগেল কপলিন (Abigail Coplin) বলেছেন, ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণায় ইতোমধ্যে সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষার জন্য বিধি-নিষেধ রয়েছে।
তিনি আরও মনে করেন, ‘উন্মুক্ত গবেষণা’ উভয় দেশকেই উপকৃত করে এবং এতে মেধাস্বত্ব কমে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনার সঙ্গে চীনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দেশটির বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা বলছেন, চীন প্রায়ই সামরিক এবং কম্পিউটার প্রযুক্তি চুরি করতে চায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত সুবিধা তৈরি করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, গবেষণা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবনগুলো রক্ষার বিষয়ে সতর্ক থাকা অপরিহার্য।
বিষয়টি শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং গবেষণার সুযোগ সীমিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, এই ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা একদিকে যেমন গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে, তেমনিভাবে জাতীয় স্বার্থকেও সুরক্ষিত রাখবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস