ইউক্রেনের রেল নেটওয়ার্ককে লক্ষ্য করে রাশিয়ার ড্রোন হামলা, খাদ্য নিরাপত্তা ও বাণিজ্যে সংকট।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে রাশিয়ার ড্রোন হামলার ঘটনা বাড়ছে, যা দেশটির অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি, রুশ বাহিনী অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ড্রোন ব্যবহার করে এই হামলাগুলো চালাচ্ছে।
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়ার এই ধরনের হামলার তীব্রতা বেড়েছে। বিশেষ করে, গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই ধরনের হামলা অনেক বেড়ে গেছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, এর মূল লক্ষ্য হল দেশটির বাণিজ্যিক ও সামরিক সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত করা।
সর্বশেষ হামলার একটি উদাহরণ হলো, গত মাসের শুরুতে উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের শোস্টকা রেল স্টেশনে ড্রোন হামলা। এতে একজন বৃদ্ধ নিহত হন এবং অন্তত আটজন আহত হন। হামলায় ট্রেনের বগিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইউক্রেনের রেলওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওলেক্সান্ডার পার্তসোভস্কি এপিকে জানান, রাশিয়া বর্তমানে অত্যাধুনিক ‘শায়েদ’ ড্রোন ব্যবহার করছে এবং তারা বিশেষভাবে লোকোমোটিভগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।
এই হামলার কারণে ইউক্রেনের রেল কর্মকর্তাদের দ্রুত মেরামতের কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা নিয়মিতভাবে রেললাইন সচল রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাশিয়ার ড্রোন প্রযুক্তির উন্নতি এবং হামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধের শুরু থেকে, ২০২২ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত, প্রতি সপ্তাহে গড়ে একটি করে রেল হামলার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে দুই থেকে তিনটিতে।
ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ওলেক্সি কুলেবা জানিয়েছেন, আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত রেল অবকাঠামোতে প্রায় ৩০০টি হামলা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১০টির মতো হামলা হচ্ছে।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান পরিষেবা অনুযায়ী, দেশটির মোট মালামাল পরিবহনের ৬৩ শতাংশ এবং যাত্রী পরিবহনের ৩৭ শতাংশ রেলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এছাড়া, শস্য ও ধাতব শিল্পজাত পণ্য সমুদ্রবন্দর ও সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এবং মিত্র দেশগুলো থেকে সামরিক সহায়তা পরিবহনেও এই রেল ব্যবস্থা অপরিহার্য।
সামরিক ও ড্রোন বিশেষজ্ঞ সের্হি বেসক্রেসনভ জানিয়েছেন, রাশিয়ার সেনারা তাদের ড্রোন বহরে নতুন কিছু প্রযুক্তি যুক্ত করেছে। এর ফলে, ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি ভিডিও দেখে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে হামলার নির্ভুলতা অনেক বেড়েছে।
বেসক্রেসনভ আরও বলেন, নতুন প্রযুক্তির কারণে লোকোমোটিভগুলো হামলার সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে, কারণ এগুলো তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে চলে এবং একটি নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “যদি রাশিয়া ক্রমাগতভাবে ডিজেল ও বৈদ্যুতিক লোকোমোটিভগুলোতে আঘাত হানে, তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন রেললাইন অক্ষত থাকলেও সেখানে ট্রেন চালানোর মতো কিছুই থাকবে না।”
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পরিবর্তিত ড্রোনগুলো ইউক্রেনের অভ্যন্তরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে এবং রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে ভিডিও পাঠাতে সক্ষম।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার মতে, ইউক্রেনীয় বাহিনী ‘গেরান’ ধরনের একটি ড্রোন উদ্ধার করেছে, যাতে বেসামরিক ক্যামেরা ও রেডিও মডেম লাগানো ছিল। ‘গেরান’ হলো ইরানের তৈরি ‘শায়েদ’ ড্রোনের একটি রুশ সংস্করণ।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, রাশিয়া নতুন প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এবং এর মাধ্যমে তারা ইউক্রেনীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চিহ্নিত করতে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে পারছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া নিয়মিতভাবে রেল অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে, ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি অঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে, ইউক্রেনের মেরামত কর্মীরাও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে ধ্বংস হওয়া ধ্বংসাবশেষ তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে ফেলছেন। বিদ্যুতের খুঁটি বা পানির লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সাধারণত একদিনের মধ্যেই তা মেরামত করা হচ্ছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও ইউক্রেনের রেলকর্মীরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিয়েভের রেল মেরামত দলের প্রধান মাকসিম শেভচুক জানিয়েছেন, একবার একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ১২ মিটার রেললাইন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যা তারা মাত্র আধা দিনের মধ্যে মেরামত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ১১.৭ শতাংশ এবং যাত্রী পরিবহন ৪.২ শতাংশ কমেছে।
কিয়েভভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজির সিনিয়র অর্থনীতিবিদ নাতালিয়া কোলেসনিচেঙ্কো বলেন, দ্রুত মেরামতের কাজ এবং রুটিং পরিবর্তনের কারণে বিলম্ব কম হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো পর্যন্ত “নগণ্য” রয়েছে।
ইউক্রেনের রেলওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওলেক্সান্ডার পার্তসোভস্কি বলেন, এই পরিস্থিতিতেও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখাটা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “আমরা ইউক্রেনীয় এবং শত্রুদের দেখাতে চাই যে, এই হামলাগুলো তাদের প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনবে না,” তিনি যোগ করেন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস