নাইজেরিয়ায় ‘খ্রিস্টান গণহত্যা’ : মার্কিন সেনেটরের দাবিতে বিতর্ক!

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টেড ক্রুজের একটি মন্তব্যের জেরে নাইজেরিয়ায় ‘খ্রিস্টান গণহত্যা’ সংঘটিত হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সিনেটর ক্রুজ নাইজেরিয়াকে ধর্মীয় স্বাধীনতার চরম লঙ্ঘনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এর প্রতিক্রিয়ায়, পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটির সরকার ক্রুজের এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটির সদস্য ক্রুজের যুক্তি হলো, নাইজেরিয়ায় ধর্মীয় স্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন হচ্ছে। তার প্রস্তাব অনুযায়ী, নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হোক।

এই তালিকায় বর্তমানে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীনের মতো দেশগুলো রয়েছে। কোনো দেশকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে, যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। সিনেট এখনো পর্যন্ত এই বিলের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

সিনেটর ক্রুজের এই অভিযোগের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সেলিব্রিটি ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার কোনো প্রমাণ ছাড়াই ‘খ্রিস্টান গণহত্যা’র মতো গুরুতর অভিযোগ করেছেন। তবে ক্রুজের অফিসের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, নাইজেরিয়ার প্রায় ২২ কোটি জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ খ্রিস্টান এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটি বোকো হারামসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।

বোকো হারাম তাদের নিজস্ব শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি, যারা তাদের মতের সঙ্গে একমত নয়, তাদেরও তারা আক্রমণ করে।

নাইজেরিয়ায় বিভিন্ন ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে থাকে। এর মধ্যে কিছু ঘটনার পেছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্য কাজ করে, যেখানে খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই আক্রান্ত হয়।

এছাড়া, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ভূমি নিয়ে কৃষক ও রাখালদের মধ্যে সংঘর্ষ, জাতিগত বিদ্বেষ থেকেও সহিংসতার সৃষ্টি হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই মুসলিম। দেশটির উত্তরাঞ্চলে এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে।

যদিও বিভিন্ন সময়ে উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং উভয় পক্ষই গণহত্যার অভিযোগ করেছে। প্রায়ই দেখা যায়, উত্তর-মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কৃষক ও রাখাল সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা হয়।

এই অঞ্চলে মূলত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কৃষকদের সঙ্গে মুসলিম ফুলানি রাখালদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে।

নাইজেরিয়ার কাদুনা রাজ্যের খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসেফ হায়া claimsব এই ‘খ্রিস্টান গণহত্যা’র অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার খ্রিস্টান নিহত হলেও পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে। তবে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনাকে তিনি নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেছেন।

নাইজেরিয়ার তথ্যমন্ত্রী ইদ্রিস মোহাম্মেদ জানিয়েছেন, সরকার বা অন্য কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী কোনো বিশেষ ধর্মের ওপর পরিকল্পিতভাবে আঘাত হানছে না।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০২০ সালে নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

তবে ২০২৩ সালে সেই তালিকা থেকে নাইজেরিয়ার নাম বাদ দেওয়া হয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের নাইজেরিয়া সফরের আগে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যই এমনটা করা হয়েছিল।

এদিকে, মার্কিন মন্তব্যকারীদের সাম্প্রতিক অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায়, খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন অব নাইজেরিয়া (Christian Association of Nigeria) দীর্ঘদিন ধরে নাইজেরিয়ার খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন (U.S. Commission on International Religious Freedom) তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে নাইজেরিয়ায় খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়টি তুলে ধরেছে।

তারা একে ধর্মীয় স্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করেছে। কমিশনের মতে, “সহিংসতা নাইজেরিয়ার বিভিন্ন রাজ্যের বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান ও মুসলিমদের প্রভাবিত করছে।”

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রোগ্রাম (ACLED)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ১১ হাজার ৮৬২টি হামলায় ২০ হাজার ৪০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এর মধ্যে, খ্রিস্টানদের ওপর হওয়া ৩৮৫টি হামলায় খ্রিস্টানদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল এবং এতে ৩১৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সময়ে, মুসলিমদের ওপর হওয়া ১৯৬টি হামলায় ৪১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ACLED-এর আফ্রিকা বিষয়ক বিশ্লেষক ল্যাড সেরওয়াতের মতে, নাইজেরিয়ার বিশাল জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিক ভিন্নতার কারণে, সহিংসতার পেছনে কেবল ধর্মকে দায়ী করা কঠিন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক কনভেনশন অনুযায়ী, নাইজেরিয়ার পরিস্থিতি গণহত্যার সংজ্ঞার সঙ্গে মেলে না।

গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মের মানুষকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করা হলে, তাকে গণহত্যা বলা হবে।

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক ওলাজুমোকে আয়াান্দেলে বলেছেন, “আমরা যা দেখছি, তা হলো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, যা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে না। গণহত্যার অভিযোগ পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে।”

অন্যদিকে, টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমাসির অধ্যাপক ও নাইজেরিয়ার মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান চিদি ওডিনকালু অবশ্য বলেছেন, নাইজেরিয়ার কর্তৃপক্ষকে এই ব্যাপক সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *