যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন অভিযানে বিতর্ক, কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সংক্রান্ত অভিযানে দেশটির নিরাপত্তা বিভাগের (DHS) দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিকাগো এবং অন্যান্য শহরে ধরপাকড়ের সময় ডিএইচএস কর্মকর্তাদের দেওয়া কিছু বিবৃতি স্থানীয় প্রশাসন, আইনজীবী এবং আদালতের নথিপত্রের সঙ্গে মিলছে না।
এই ধরনের অসঙ্গতি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় বিশেষভাবে দেখা গেছে: শিকাগোর একটি টিভি চ্যানেলের কর্মীকে গ্রেপ্তার, পুলিশের গাড়িতে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগে এক মার্কিন নাগরিকের ওপর গুলি এবং ম্যাসাচুসেটস-এ ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরকে আটক করা।
এই ঘটনাগুলো ডিএইচএস-এর বিবৃতির প্রতি বৃহত্তর সন্দেহ তৈরি করেছে, যখন ফেডারেল এজেন্টরা শিকাগোসহ বিভিন্ন শহরের রাস্তায় অভিযান চালাচ্ছে। গত সপ্তাহে, একজন ফেডারেল বিচারক ইলিনয়ে ন্যাশনাল গার্ডের সেনা মোতায়েন স্থগিত করেন।
বিচারক জানান, বিক্ষোভ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য “ভরাসাযোগ্য নয়।” কর্তৃপক্ষ অস্ত্র বহন ও ফেডারেল এজেন্টদের ওপর হামলার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও, বিচারক জানান, ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি অন্তত তিনজন অভিযুক্তকে অভিযুক্ত করতে রাজি হয়নি, যা যথেষ্ট কারণের অভাব নির্দেশ করে।
মার্কিন জেলা আদালতের বিচারক এপ্রিল পেরি তাঁর আদেশে এই ঘটনাগুলোর বিষয়ে বলেন, “এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সততার অভাব রয়েছে এবং তাদের তথ্য সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।”
ডিএইচএস-এর দেওয়া তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সাধারণ নাগরিক বা অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সিএনএনের আইন বিশ্লেষক এবং প্রাক্তন ফেডারেল প্রসিকিউটর এলিয়ট উইলিয়ামস বলেন, “আইনজীবীর বিশ্বাসযোগ্যতা শুধু ব্যক্তিগত সততার বিষয় নয়; রায় দেওয়ার সময় বিচারকদের এটি বিবেচনা করতে হয়।
ডিএইচএস-এর সমস্যা হলো, তাদের কাজ এবং আইনজীবীদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিচারকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।” ডিএইচএস জানিয়েছে, তারা “সবচেয়ে খারাপ অপরাধীদের” গ্রেপ্তার করছে এবং তাদের এজেন্টরা হামলার শিকার হচ্ছে।
এই বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি বুঝতে, সিএনএন ডিএইচএস-এর দেওয়া তিনটি আলোচিত ঘটনার বিবৃতিগুলো খতিয়ে দেখেছে।
ডিএইচএস-এর দেওয়া তথ্যের সঙ্গে অন্যান্য প্রমাণের অমিল সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা আগে যা বলেছি, তার প্রতিই অবিচল আছি।”
**ডব্লিউজিএন কর্মীর গ্রেপ্তার**
গত সপ্তাহে, শিকাগোর একটি টিভি স্টেশন ডব্লিউজিএন-এর এক কর্মীকে গ্রেপ্তারের ভিডিও ধারণ করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, কর্মকর্তারা ডেবোরা ব্রকম্যান নামের ওই কর্মীকে মাটিতে ফেলে হাতকড়া পরাচ্ছেন।
পরে তাকে একটি সাদা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জোশ থমাস সিএনএনকে বলেন, “আমি এজেন্টদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তারা এই ব্যক্তিকে আটক করছে?
তারা মূলত জানায়, তিনি বিচার কাজে বাধা দিচ্ছিলেন।” ব্রকম্যানের আইনজীবীদের মতে, প্রায় সাত ঘণ্টা আটকের পর ব্রকম্যানকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর, ডিএইচএস-এর সহকারী সচিব ট্রিসিয়া ম্যাকলফলিন এক্স-এ (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী অভিবাসন বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনার সময় ব্রকম্যানকে গ্রেপ্তার করে।
ম্যাকলফলিন বলেন, “মার্কিন নাগরিক ডেবোরা ব্রকম্যান বর্ডার পেট্রোলের গাড়িতে কিছু ছুড়ে মারেন, যার কারণে তাকে ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার ওপর হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।”
তবে, ব্রকম্যানের আইনজীবীরা ম্যাকলফলিনের বিবৃতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, ঘটনার দিন সকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় ফেডারেল এজেন্টরা ব্রকম্যানের ওপর হামলা করেন।
**গাড়ির ধাক্কা ও আগ্নেয়াস্ত্রের অভিযোগ**
ডিএইচএস-এর দেওয়া তথ্যে ৩৫ বছর বয়সী এক মার্কিন নাগরিককে গুলি করার ঘটনার বিষয়েও অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।
গত ৪ অক্টোবর শিকাগোতে কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি) এজেন্টের গুলিতে মারিমার মার্টিনেজ নামে ওই মার্কিন নাগরিক আহত হন। ম্যাকলফলিন এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে জানান, কয়েকজন চালক, যাদের মধ্যে একজন “সেমি-অটোমেটিক অস্ত্র” সহ পুলিশের একটি গাড়িতে ধাক্কা দেয়।
ডিএইচএস-এর এক প্রেস রিলিজেও বলা হয়, মার্টিনেজের কাছে “একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল।” এতে এমন ধারণা পাওয়া যায় যে, মার্টিনেজ গুলি করার সময় অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিলেন।
মার্টিনেজের বিরুদ্ধে ফেডারেল আদালতে ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে, অভিযোগপত্রে আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, মার্টিনেজ একটি সিবিপি গাড়িতে ধাক্কা দেন। এরপর এক এজেন্ট গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে মার্টিনেজের দিকে গুলি চালান।
মার্টিনেজের আইনজীবী ক্রিস্টোফার প্যারেন্তে সিএনএনকে জানান, তাঁর মক্কেলের কাছে বৈধ লাইসেন্স ছিল এবং তাঁর ব্যাগে একটি হ্যান্ডগান ছিল, তবে সেটি “ঘটনার সময় বের করা হয়নি।”
প্যারেন্তে আরও জানান, তিনি বডি-ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছেন, যেখানে দেখা যায় সিবিপি’র একটি গাড়ি মার্টিনেজের গাড়ির দিকে মোড় নেয়। এরপরই একজন অফিসার গাড়ি থেকে নেমে মার্টিনেজের দিকে গুলি চালান।
প্যারেন্তে বলেন, “সরকার যা বলছে, ঘটনাটি আসলে তেমন নয়।”
**ম্যাসাচুসেটসের কিশোরের আটক**
গত ৯ অক্টোবর, ম্যাসাচুসেটসের এভারেট-এ ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরকে আটক করে আইস (ICE)। স্থানীয় কর্মকর্তারা ডিএইচএস-এর দেওয়া একটি তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
এভারেটের মেয়র কার্লো ডিমোরিয়া জানান, ওই কিশোরের বিরুদ্ধে অন্য এক কিশোরকে মারধরের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ছিল। তিনি অস্ত্রের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করেননি এবং জোর দিয়ে বলেন, কিশোরের কাছে কোনো বন্দুক পাওয়া যায়নি।
ডিএইচএস-এর সহকারী সচিব ম্যাকলফলিন এক্স-এ দেওয়া পোস্টে জানান, ওই কিশোরের কাছে একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৫-৭ ইঞ্চি লম্বা ছুরি ছিল।
ডিএইচএস-এর পক্ষ থেকে ম্যাকলফলিনের বক্তব্য এবং মেয়রের দেওয়া তথ্যের মধ্যে অমিল নিয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
**বডি ক্যামেরা ব্যবহারের আহ্বান**
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন রয়েছে। গ্রেপ্তারের পরপরই পুলিশের দেওয়া বিবৃতিগুলোও ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ঘটনা প্রথমদিকে মিনিয়াপলিস পুলিশ “পুলিশের সঙ্গে কথোপকথনের সময় চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতায় এক ব্যক্তির মৃত্যু” হিসেবে বর্ণনা করেছিল।
সিএনএনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং প্রাক্তন ডিএইচএস নির্বাহী জুলিওট কায়েয়াম বলেন, “এখন সবার হাতে ক্যামেরা থাকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিবাসন বিষয়ক কার্যক্রমের ভিডিও ছড়ানোয় বিভ্রান্তিকর দাবিগুলো সহজেই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।
ডিএইচএস-কে বুঝতে হবে, কৌশল সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তিকর দাবি করলে তা সহজেই ভুল প্রমাণ করা সম্ভব, বিশেষ করে যদি এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে।” এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, অভিবাসন বিষয়ক অভিযানে বডি-ক্যামেরার ব্যবহার বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বডি ক্যামেরা ঘটনার আগে পরিস্থিতি ধারণ করে এবং বিতর্কিত ঘটনার সত্যতা প্রমাণে সাহায্য করে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন