শিরোনাম: রূপচর্চার সামগ্রীতে এখনো লুকিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক: সচেতনতা জরুরি
রূপচর্চার জিনিসপত্রের মোড়কে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে আমরা প্রায়ই বাজার থেকে নানান পণ্য কিনি। ত্বককে আরও উজ্জ্বল করতে, চুলের স্বাস্থ্য ফেরাতে এইসব প্রসাধনী সামগ্রীর জুড়ি মেলা ভার।
কিন্তু এই রূপচর্চার সামগ্রীর আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু রাসায়নিক উপাদান। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ব্যবহৃত কিছু প্রসাধনী সামগ্রীর ওপর চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৫২ শতাংশ পণ্যে ‘পিএফএএস’ (PFAS) নামক রাসায়নিক পাওয়া গেছে। এই রাসায়নিক উপাদান হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ফাউন্ডেশন, ওয়াটারপ্রুফ মাসকারা ও লিপস্টিকে এই ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি। উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক পণ্যের মোড়কে এই রাসায়নিকের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয় না।
ফলে, ব্যবহারকারীরা অজান্তেই এইসব ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের জন্য তৈরি করা প্রসাধনীতে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকে। যেমন, কিছু হেয়ার স্ট্রেটনারে ‘ফর্মালডিহাইড’ (formaldehyde) নামক রাসায়নিক পাওয়া যায়, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
তবে, আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ‘কেমফরোয়ার্ড’ (ChemFORWARD) নামক একটি সংস্থার মতে, বর্তমানে বাজারে নিরাপদ রাসায়নিক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে।
তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রূপচর্চার পণ্যগুলোতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখনো কিছু পণ্যে উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
লিপস্টিক, ময়েশ্চারাইজার, কন্সিলার, শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারের মতো পণ্যে এখনো কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই বিষয়ে ‘এনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর (Environmental Working Group – EWG) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডেভিড অ্যান্ড্রুজ় বলেন, “কোম্পানিগুলো ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা বন্ধ করলেও, বাজারের সব পণ্য থেকে সেগুলো সরানো সম্ভব হয় না।
ফলে, ভোক্তাদের সচেতন থাকতে হবে এবং পণ্য কেনার সময় সতর্ক থাকতে হবে।”
কেমফরোয়ার্ডের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রায় ১.২৫ মিলিয়ন উপাদানের মধ্যে ৭১ শতাংশের বেশি উপাদান মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ বা উদ্বেগের কারণ নয়।
উদাহরণস্বরূপ, গ্লিসারিন ও হায়ালুরোনিক অ্যাসিড ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও, মেকআপে রং যোগ করতে ব্যবহৃত আয়রন অক্সাইড এবং ভিটামিন ই-এর সিনথেটিক রূপ ‘টোকোফেরিল অ্যাসিটেট’-ও নিরাপদ।
তবে, সবার ত্বক একই রকম নয়। তাই, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি বা ত্বকের সংবেদনশীলতা দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রায় ২৪ শতাংশ রাসায়নিকের নিরাপত্তা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি পণ্যে ‘ক্ষতিকর উপাদান নেই’ এমনটা লেখা থাকলেও, সেখানে এমন কিছু রাসায়নিক থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর।
কেমফরোয়ার্ডের বিশেষজ্ঞ হিদার ম্যাককেনি বলেন, “উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর উচিত ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া।
ভোক্তাদের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়।”
ভোক্তাদের সচেতনতার জন্য, কেমফরোয়ার্ড তাদের প্রতিবেদনে কিছু সাধারণ ক্ষতিকর রাসায়নিকের তালিকা প্রকাশ করেছে। যেমন, ‘সাইক্লোপেন্টাসিলোক্সেন’ ও ‘সাইক্লোমেথিকন’ নামক সিলিকন, যা ত্বক ও চুলের পণ্যে মসৃণতা আনতে ব্যবহৃত হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) এই দুটি রাসায়নিকের ব্যবহার সীমিত করেছে, কারণ এগুলো জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর।
এছাড়াও, ‘মিথাইল প্যারাবেন’ (methylparaben), যা প্রসাধনীতে সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তা হরমোন-সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি করতে পারে।
‘ডি অ্যান্ড সি রেড ২৭, ২৮ ও অ্যাসিড রেড ৯২’ (D&C Red 27, 28 & Acid Red 92) নামক রং, যা দীর্ঘস্থায়ী লিপস্টিক-এর মতো পণ্যে ব্যবহার করা হয়, তা প্রজনন, হরমোন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
‘বিএইচটি’ (BHT) নামক একটি উপাদান, যা ত্বক শোষণ করে এবং জলজ জীবনের জন্য ক্ষতিকর, তা অনেক লোশন, ক্রিম ও অন্যান্য পণ্যে পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর রাসায়নিকের পরিবর্তে এখন নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাই, উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে।
আমাদের দেশেও রূপচর্চার পণ্যের বাজার বাড়ছে। তাই, ভোক্তাদের সচেতনতা খুবই জরুরি।
পণ্য কেনার আগে মোড়কের উপাদানগুলো ভালোভাবে দেখে নেওয়া উচিত।
এছাড়াও, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, এই ধরনের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।
তথ্য সূত্র: সিএনএন