মেক্সিকোর উপসাগরে ধীর গতিতে এগিয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘মেলিসা’ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি করেছে। জ্যামাইকা, হাইতি এবং ডোমিনিকান রিপাবলিকের জন্য এটি এক চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ ঝড়টি ধীরে চলায় এই অঞ্চলে কয়েক দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, এর প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় এসব এলাকার জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার (National Hurricane Center)-এর তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে ঘূর্ণিঝড় মেলিসা জ্যামাইকার কিংস্টন থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দূরে অবস্থান করছিল। সে সময় এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৫০ মাইল।
বর্তমানে এটি ঘণ্টায় মাত্র ২ মাইল বেগে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সাধারণত একজন মানুষ স্বাভাবিক হাঁটাচলার সময় যে গতিতে হাঁটে, মেলিসার গতি তার চেয়েও কম।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ঝড়টি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সপ্তাহান্তে এটি হারিকেনে পরিণত হতে পারে এবং আগামী সপ্তাহের শুরুতে ক্যাটাগরি ৩ বা তার চেয়েও শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
এমনটা ঘটলে এটি হবে চলতি আটলান্টিক হারিকেন মৌসুমের চতুর্থ শক্তিশালী ঝড়, যা আগে খুব কমই দেখা গেছে। কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির হারিকেন গবেষক ফিল ক্লটজবাখের মতে, এর আগে ১৯৩২, ১৯৯৯ এবং ২০১০ সালে এমনটা ঘটেছিল।
মেলিসার প্রভাবে ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিছু অংশে ইতিমধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, শনিবার পর্যন্ত হাইতির দক্ষিণাঞ্চল, ডোমিনিকান রিপাবলিকের দক্ষিণ এবং জ্যামাইকার পূর্বাঞ্চলে ১০ ইঞ্চির বেশি বৃষ্টি হতে পারে।
কোনো কোনো স্থানে এই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এক ফুটের বেশি হতে পারে। হারিকেন সেন্টার জানিয়েছে, পাহাড়ি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের সম্ভবনা রয়েছে, যা জীবনহানির কারণ হতে পারে।
মেলিসা বর্তমানে এমন একটি স্থানে আটকা পড়েছে, যেখানে দুটি ভিন্ন আবহাওয়া পদ্ধতির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এর ফলে জ্যামাইকা এবং হিসপানিওলার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে।
যদি ঝড়টি ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে এটি জ্যামাইকার দক্ষিণে আগামী সপ্তাহের শুরু পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে। এই অঞ্চলের উষ্ণ সমুদ্র এটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে এবং সোমবারের মধ্যে এটি ক্যাটাগরি ৪-এর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে।
এমনটা ঘটলে জ্যামাইকা ও হাইতির দক্ষিণাঞ্চলে ধ্বংসাত্মক বাতাস, জলোচ্ছ্বাস এবং ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, যদি জেট স্ট্রিম মেলিসাকে দ্রুত উত্তর দিকে টেনে নেয়, তাহলে এটি হাইতি অথবা ডোমিনিকান রিপাবলিকের দিকে যেতে পারে। এর ফলে ঝড়ের তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে, তবে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে সরাসরি আঘাত হানবে।
হিসপানিওলার ভূ-প্রকৃতির কারণে এখানে আরও বেশি বৃষ্টি হবে, যা ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা কম থাকলেও, দেশটির পূর্বাঞ্চলে এর প্রভাব পড়তে পারে। মেলিসা যদি উত্তর দিকে যেতে বেশি সময় নেয়, তাহলে এটি কিউবা বা বাহামাসের দিকে মোড় নিতে পারে এবং পরে আটলান্টিকের দিকে চলে যেতে পারে।
তবে সেক্ষেত্রেও আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল জুড়ে ঢেউ এবং স্রোতের সৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সাধারণত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সমুদ্রের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি হ্রাস পায়। কিন্তু এবার ক্যারিবীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা রেকর্ড পরিমাণ বেশি, যা মেলিসাকে শক্তিশালী করে তুলছে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে এবং বৃষ্টির পরিমাণও বাড়ছে। এর আগে, চলতি বছরই আটলান্টিক মহাসাগরে আঘাত হানা চারটি হারিকেনের মধ্যে তিনটি দ্রুত শক্তিশালী হয়েছে।
মেলিসার গতিপথ এবং শক্তি আগামী দিনগুলোতে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে এর বিপদ সংকেত ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। একটি ধীর গতির ঝড়, উষ্ণ সমুদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের বসবাস—সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক।
তথ্য সূত্র: সিএনএন