**গুগলের নারী প্রযুক্তিবিদদের সহায়তা কর্মসূচি বন্ধ: বিতর্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি**
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি গুগল, তাদের দীর্ঘদিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি, ‘উইমেন টেকমেকার্স’ (Women Techmakers) বন্ধ করে দিয়েছে। নারীদের প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ২০১২ সালে এই উদ্যোগটি শুরু করা হয়েছিল।
সম্প্রতি এক সংক্ষিপ্ত ইমেইলের মাধ্যমে কর্মসূচিটি বাতিলের ঘোষণা আসায় এর সঙ্গে জড়িত নারী প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
কর্মসূচিটির সঙ্গে জড়িত ক্যানাডার গুগলের প্রকৌশলী ব্যবস্থাপক শেরী ইয়াং সিএনএনকে জানান, “উইমেন টেকমেকার্সের জন্য আমি যা কিছু তৈরি করেছি, তার সবই এখন মুছে গেছে।
এই কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত বহু নারী অ্যাম্বাসেডর ছিলেন, যারা অনেক শ্রম দিয়েছেন। তাদের ইতিহাসও যেন মুছে ফেলা হলো।”
জানা গেছে, প্রযুক্তি খাতে নারীদের সহায়তা করার এই প্রোগ্রামটি বন্ধ করার পাশাপাশি, গুগলের অভ্যন্তরে এর কার্যক্রমও গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানিটি সম্ভবত তাদের বিভিন্ন ‘বৈচিত্র্য কর্মসূচি’ (diversity programs) গুটিয়ে নিচ্ছে, যার কারণ হতে পারে বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপ।
গুগল জানিয়েছে, ‘টেকনোভেশন’ নামের একটি বহিরাগত সংস্থা এখন থেকে এই প্রোগ্রামটি পরিচালনা করবে।
তবে উইমেন টেকমেকার্সের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে তারা গুগল-এর মতো প্রভাবশালী একটি কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ও সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবেন।
গ্রিসের এআই গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপক এবং প্রাক্তন উইমেন টেকমেকার্স অ্যাম্বাসেডর ভাসিলিকি দালাকিয়ারি সিএনএনকে বলেন, “এর মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে নারীদের, বিশেষ করে সাধারণভাবে নারীদের প্রতি একটি বার্তা দেওয়া হলো যে, বড় কর্পোরেশনগুলো থেকে আমরা সবসময় সমর্থন আশা করতে পারি না।
আমাদের কথা শোনা না পর্যন্ত কথা চালিয়ে যেতে হবে। গুগল একসময় আমাদের সাহায্য করেছিল, কিন্তু তারা নীরবে আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।”
গুগলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
তবে প্রোগ্রামটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, টেকনোভেশনকে এই পরিবর্তনের সময় সহায়তা ও অর্থ দিচ্ছে গুগল।
টেকনোভেশন-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারা চকলোভস্কি সিএনএনকে জানান, গুগল থেকে তারা তহবিল পাচ্ছেন, যা উইমেন টেকমেকার্স সদস্যদের জন্য “আরো গভীর প্রোগ্রামিং সহায়তা” দেবে।
এই গ্রুপের সদস্যরা আগের মতোই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (গুগল ছাড়াও) প্রযুক্তি নেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
তবে সংশ্লিষ্ট নারীদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে একটি কমিউনিটি তৈরি করার পর, গুগল যেন তাদের একরকম ছুঁড়ে ফেলেছে।
তাদের মতে, এই কমিউনিটি তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক সহায়তা করেছে, বিশেষ করে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত একটি পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উইমেন টেকমেকার্স মূলত প্রশিক্ষণ, স্কলারশিপ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারা বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে নারীদের দৃশ্যমানতা, একটি কমিউনিটি তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে কাজ করত।
এর সদস্যরা গুগল-এর কর্মী হোক বা না হোক, সবাই এই সুযোগ পেতেন।
যারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন, তাদের অ্যাম্বাসেডর হওয়ার সুযোগ ছিল এবং গুগল ডেভেলপার ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণের জন্য আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হতো।
ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গুগলের অভ্যন্তরে এই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন কমতে শুরু করে।
কোম্পানিটি জানায়, তারা এখন থেকে ‘বৈচিত্র্য কর্মী নিয়োগের’ (diversity hiring) লক্ষ্য নির্ধারণ করবে না এবং অন্যান্য ‘বৈচিত্র্য কর্মসূচি’ পর্যালোচনা করবে।
কারণ হিসেবে তারা জানায়, সরকারি সংস্থা ও ঠিকাদারদের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি বিষয়ক নির্বাহী আদেশ তাদের মানতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এশিয়া অঞ্চলের একজন উইমেন টেকমেকার্স সদস্য ‘টিয়া’ জানান, অ্যাম্বাসেডরদের জন্য অনুষ্ঠান আয়োজন ও ভ্রমণের খরচ পাওয়া আগের চেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ঘটনার পর অনেকেই গুগলের এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না।
তাদের মতে, কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই, শুধু একটি ইমেইলের মাধ্যমে প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দেওয়াটা তাদের হতাশ করেছে।
ব্রাসেলস-ভিত্তিক ডেটা বিজ্ঞানী লেইলা দামোইসাক্স-ডেলনয়ি তার লিঙ্কডইন পোস্টে লেখেন, “যখন একটি কোম্পানির সমতার প্রতি অঙ্গীকার একটি ইমেইলে শেষ হয়, তখন বোঝা যায় তাদের এই অঙ্গীকারের মূল্য কতটুকু ছিল।”
বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বর্তমানে তাদের ‘বৈচিত্র্য কর্মসূচি’ কমিয়ে দিচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, একদিকে যেমন ফেডারেল সরকারের চাপ কমেছে, তেমনি ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য পদক্ষেপের ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করছে।
তবে প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডোনাল্ড টমাসকোভিক-ডেভি মনে করেন, শুধুমাত্র বিশেষ কর্মসূচি চালু করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কর্মক্ষেত্রে সবার প্রতি সম্মান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা।
তথ্য সূত্র: সিএনএন