ট্রাম্প ফিরতেই নীরব উত্তর কোরিয়া: আলোচনার আগ্রহ নেই?

শিরোনাম: ট্রাম্পের এশিয়া সফর: উত্তর কোরিয়ার নীরবতা, বদলে যাওয়া পিয়ংইয়ং।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক এশিয়া সফরকালে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তার সম্ভাব্য বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। তবে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে এ নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।

বরং, দেশটির রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে যেন ট্রাম্পের এই সফরের কোনো প্রভাবই পড়েনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, এর কারণ হলো উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া কিছু পরিবর্তন।

ট্রাম্প যখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছিলেন, তখন সবার মনে একটাই প্রশ্ন ছিল – উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তার কোনো বৈঠক হবে? ২০১৬ ও ২০১৯ সালে ট্রাম্প ও কিমের মধ্যেকার বৈঠকগুলো বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

এমনকি ২০১৯ সালে, ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার মাটিতে পা রাখা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, এবারও হয়তো তেমন কিছু ঘটবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি।

পিয়ংইয়ংয়ে যেন ট্রাম্পের এ সফর ছিল নিছকই একটি ‘ভূতুড়ে’ ঘটনা। দেশটির গণমাধ্যমে এ নিয়ে কোনো খবর আসেনি। এমনকি, ট্রাম্প যে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কিমের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী, এমন প্রস্তাব দিলেও, উত্তর কোরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে নীরব ছিল।

সম্প্রতি পিয়ংইয়ং সফর করে আসা আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা জাস্টিন মারটেল জানান, সেখানে অধিকাংশ মানুষ ট্রাম্পের এশিয়া সফরের বিষয়ে অবগতই ছিলেন না। এমনকি, ট্রাম্প যে পুনরায় কিমের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, সে খবরও তাদের কাছে অজানা ছিল।

মারটেল সিএনএনকে বলেন, “এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না। আবার, তারা খুব বেশি আশাবাদীও ছিলেন না। তারা কেবল কিম জং উনের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো পুনরাবৃত্তি করছিলেন – যেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ স্মৃতিচারণ করলেও, রাজনীতির সঙ্গে অনুভূতির পার্থক্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন।”

মারটেলের মতে, সেখানকার পরিবেশ ছিল অনেকটা উদাসীন। যেন, ‘যদি দেখা হয়, ভালো। না হলেও কিছু যায় আসে না।’।

এই নির্লিপ্ততা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কারণ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ট্রাম্প ও কিমের মধ্যেকার শীর্ষ বৈঠকগুলো – যা সিঙ্গাপুর, হ্যানয় ও ডিএমজেডে (Demilitarized Zone) অনুষ্ঠিত হয়েছিল – উভয় দেশের রাজধানীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর প্রধান কারণ হলো, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। গত মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এক সামরিক কুচকাওয়াজে কিম জং উন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যোগ দেন, যা পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে তাদের জোটবদ্ধতার একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়।

এখন উত্তর কোরিয়া অস্ত্র ও তেলের জন্য রাশিয়ার ওপর এবং বাণিজ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে দেশটির জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের আগের মতো গুরুত্ব নেই। ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন যে, বৈঠকের সুযোগ তৈরি না হওয়ার কারণ ছিল সময়ের অভাব। উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চো সন হুইও ওই সময়ে রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।

তবে, মারটেলের পর্যবেক্ষণ বলছে, সময়ের অভাব ছাড়াও অন্য কিছু কারণ থাকতে পারে। কিম জং উন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ‘অযৌক্তিক’ দাবি ত্যাগ করে, তবেই তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে বসতে রাজি।

সেপ্টেম্বর মাসের এক ভাষণে কিম বলেছিলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার ‘সুন্দর স্মৃতি’ রয়েছে, তবে তার দেশ নিষেধাজ্ঞার বিনিময়ে পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করবে না।

পিয়ংইয়ংয়ের অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। তাদের হাতে এখন আধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের জীবনে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। রাজধানীতে আধুনিক বহুতল ভবন এবং যানজট এখন একটি সাধারণ দৃশ্য।

মারটেল জানান, পিয়ংইয়ং এখন আধুনিক শহরের মতোই লাগছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পিয়ংইয়ংয়ে আধুনিক রেস্তোরাঁগুলোতে স্থানীয়দের ভিড়, উন্নতমানের পানীয়ের সমাহার, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শহরটির অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এমনকি, কিম ইল-সং স্কয়ারে শ্রমিক দলের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন যে চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ার সেনারা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে।

উত্তর কোরিয়ার চলচ্চিত্রও এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। পিয়ংইয়ং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নতুন একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে, যেখানে সহিংসতা এবং নগ্নতার মতো বিষয়গুলোও দেখা গেছে।

তবে ট্রাম্পের প্রতি দেশটির শ্রদ্ধাবোধ এখনো অটুট রয়েছে। আন্তর্জাতিক মৈত্রী প্রদর্শনীতে বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া উপহার সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়। মারটেল জানান, সেখানে কিম জং উনের অংশে পুতিন, লাভরভ, শি জিনপিং এবং ডেনিস রডম্যানের ছবির পাশেই ট্রাম্পের ছবি এখনো স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

ট্রাম্পও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি ভবিষ্যতে কিমের সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি বলেন, “আমরা অন্যান্য সফর করব এবং কিম জং উন এবং সবার সঙ্গে কাজ করে বিষয়গুলো সুরাহা করার চেষ্টা করব।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *