ফ্রান্সে হলোকাস্ট স্মৃতিসৌধে ভাঙচুরের ঘটনা, যার সঙ্গে রাশিয়ার যোগসূত্র?
প্যারিস, ফ্রান্স – প্যারিসের একটি আদালতে বর্তমানে তিনজন বুলগেরীয় নাগরিকের বিচার চলছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, শহরের হলোকাস্ট স্মৃতিসৌধে রক্তের মতো লাল হাতের ছবি আঁকার সঙ্গে তারা জড়িত। ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে, এই কাজটি আসলে ফ্রান্স এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতে অস্থিরতা তৈরির জন্য রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।
গত বছর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা ইহুদিদের বাঁচাতে সাহায্য করেছিলেন, তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তৈরি করা স্মৃতিসৌধের দেওয়ালে এবং প্যারিসের আশেপাশে প্রায় ৫০০টি লাল হাতের ছবি আঁকা হয়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, গাজায় যুদ্ধের কারণে ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ বেড়ে যাওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে।
আদালতের নথিপত্র অনুযায়ী, ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ তৈরি, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ানো এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য রাশিয়া ভাড়াটে ব্যবহার করে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ইউরোপের বিভিন্ন সরকার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটানোর জন্য লোক ভাড়া করার অভিযোগ এনেছে।
হলোকাস্ট স্মৃতিসৌধের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজন বুলগেরীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন বর্তমানে আটক আছেন এবং বুধবারের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। মূল অভিযুক্ত মিরকো অ্যাঞ্জেলভ পলাতক রয়েছেন।
আদালতে প্রথম সাক্ষী হিসেবে হাজির হওয়া জর্জি ফিলিপভ জানান, তিনি ১০০০ ইউরোর বিনিময়ে লাল হাতের ছবি আঁকেন, যা দিয়ে তিনি তার ৯ বছর বয়সী ছেলের ভরণপোষণের খরচ চালাবেন। ফিলিপভ আরও জানান, অ্যাঞ্জেলভ তাকে এই কাজের জন্য টাকা দিয়েছিলেন। রাশিয়ার জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
আদালতে দেওয়া বক্তব্যে ফিলিপভ বলেন, “আমি স্বীকার করছি যে, আমি এই কাজে অংশ নিয়েছি। আমি ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চাইছি এবং এই ক্ষতিসাধনের জন্য দুঃখিত। একইসঙ্গে ফরাসি কর্তৃপক্ষের কাছেও আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
আদালতে তিনি আরও জানান, একসময় তিনি নব্য-নাৎসি ছিলেন এবং সামাজিক মাধ্যমে তার নাৎসি-সংক্রান্ত ছবি ও হিটলারের প্রশংসা করে পোস্ট দেওয়ার কারণে তাকে হয়তো এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। তিনি তার শরীরে থাকা ট্যাটুগুলোকে “অতীতে করা একটি খারাপ কাজ” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ঘটনার পরে বুলগেরিয়ায় ফিরে আসার পরেই তিনি এর ইহুদিবিদ্বেষী চরিত্র বুঝতে পারেন বলে জানান।
কিরিল মিলুশেভ নামের অপর এক অভিযুক্ত আদালতে জানান, অ্যাঞ্জেলভের নির্দেশে তিনি ছবি আঁকার কাজটি ভিডিও করেন এবং এর জন্য ৫০০ ইউরো পান।
মিলুশেভ বলেন, “আমি এই কাজে অংশ নিয়েছি বলে দুঃখিত।”
তদন্তকারীরা বলছেন, মিলুশেভের বিরুদ্ধে জার্মানির মিউনিখে একটি সমাধির ক্ষতিসাধন এবং গত বছর ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনের আগে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের হোটেলগুলোর কাছে স্টিকার লাগানোরও অভিযোগ রয়েছে।
তৃতীয় অভিযুক্ত নিকোলাই ইভানোভকে রাশিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার চারটি ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি রাশিয়া-পন্থী কোনো সম্পর্ক বা অনুভূতির কথা অস্বীকার করেছেন এবং লাল হাতের ছবি আঁকার সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই বলেও দাবি করেন।
ইভানোভের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অন্য অভিযুক্তদের বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া থেকে ব্রাসেলস এবং সেখান থেকে প্যারিসের বাসের টিকিট কিনে দিয়েছিলেন এবং প্যারিসের হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি জানান, অ্যাঞ্জেলভের অনুরোধে তিনি টিকিট ও হোটেলের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তিনি কেবল “একজন বন্ধুর প্রতি সহযোগিতা” করেছেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জাতি, ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং সম্পত্তির গুরুতর ক্ষতিসাধনসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের কয়েক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
এ মামলার বাদীপক্ষের মধ্যে রয়েছে প্যারিস হলোকাস্ট মেমোরিয়াল এবং বর্ণবাদ ও ইহুদিবিদ্বেষ বিরোধী লীগ।
লাল হাতের ছবি আঁকার ঘটনাটি গত দুই বছরে ফ্রান্সে ঘটা বেশ কয়েকটি উদ্ভট ঘটনার মধ্যে অন্যতম, যা বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি। এছাড়াও, আরও কিছু ঘটনার কথা জানা যায়:
২০২৩ সালের অক্টোবরে, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পরপরই প্যারিসের বিভিন্ন ভবনে নীল রঙের তারকাচিহ্ন আঁকা হয়। ফরাসি কর্তৃপক্ষ এর জন্য রুশ নিরাপত্তা সংস্থাকে দায়ী করে। এ ঘটনায় দুই মালদোভানকে আটক করে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
২০২৪ সালের জুনে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ফ্রান্স সফরের আগে আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে ইউক্রেন সম্পর্কিত বিষয় উল্লেখ করে পাঁচটি কফিন রাখা হয়। লাল হাতের মামলার আসামি ফিলিপভ জানান, প্রথমে তাকে কফিনগুলো পরিবহনের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল, তবে প্যারিসের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্কের নিচে রাখতে বলার পর তিনি রাজি হননি। এই ঘটনায় বুলগেরিয়া, জার্মানি ও ইউক্রেনের আরও তিনজন নাগরিক সন্দেহভাজন এবং তাদের গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
জেলেনস্কি সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফরাসি রাজধানীতে সাক্ষাত করার কয়েক দিন পর প্যারিসের রাস্তায় ইউক্রেন সম্পর্কিত ছবি এবং বার্তা দেখা যায়। এ ঘটনায় তিনজন মালদোভানকে আটক করে তদন্ত চলছে।
গত মাসে, প্যারিস অঞ্চলের নয়টি মসজিদের কাছে শূকরের কাটা মুণ্ডু পাওয়া যায়, যার মধ্যে পাঁচটিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর নাম লেখা ছিল। এ ঘটনার তদন্ত চলছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস