নতুন ফ্যাশন: বিদেশি প্রাণী থেকে তৈরি হচ্ছে চামড়ার ব্যাগ ও পোশাক।
ফ্যাশন দুনিয়ায় চামড়ার ব্যবহার বহু পুরনো। তবে পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে বর্তমানে বিকল্প উপায়ের সন্ধান চলছে।
গরুর চামড়ার উৎপাদন বনভূমি ধ্বংস, জমির অবক্ষয় এবং প্রচুর জল ব্যবহারের মতো সমস্যা তৈরি করে। এই কারণে, বর্তমানে ভেগান বা পরীক্ষাগারে তৈরি চামড়ার চাহিদা বাড়ছে।
তবে, একটি মার্কিন কোম্পানি অভিনব উপায়ে চামড়া তৈরি করছে – যা তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি প্রাণী থেকে।
ফ্লোরিডার বৃহত্তর এভারগ্লেডসের বার্মিজ অজগর, মিসিসিপি নদী অববাহিকার সিলভারফিন কার্প এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের লায়নফিশ – এই তিনটি আগ্রাসী প্রজাতি ব্যবহার করছে মিয়ামি-ভিত্তিক স্টার্টআপ ইনভার্সা। এই চামড়া ব্যবহার করে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তৈরি করছে পোশাক, ব্যাগ এবং অন্যান্য ফ্যাশন অনুষঙ্গ।
গ্যাব্রিয়েলা হার্স্ট, খাইত, ক্যাথরিন হোলস্টেইন এবং জোহানা ওর্টিজের মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যে এই চামড়া ব্যবহার করছে।
ইনভার্সার সিইও, আরভ চাভদা, যিনি কোম্পানিটি ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন, বলেন, “বিষয়টা শুরু হয়েছিল একটা মাছ দিয়ে। আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে স্কুবা ডাইভিং করি, এবং ক্যারিবিয়ান ও ভূমধ্যসাগরে লাইয়নফিশ নামক আগ্রাসী মাছগুলোর কারণে প্রবাল প্রাচীরের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা আমাকে চিন্তিত করে তুলেছিল।”
আগ্রাসী প্রজাতি হলো সেইসব প্রাণী বা উদ্ভিদ, যা মানুষের মাধ্যমে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে অন্য কোনো অঞ্চলে আসে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে। উদাহরণস্বরূপ, এগুলো স্থানীয় প্রজাতিকে খেয়ে ফেলে, রোগ ছড়ায় অথবা খাদ্য ও সম্পদের জন্য অন্যান্য জীবের সাথে প্রতিযোগিতা করে। এর ফলে অনেক সময় প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
চাভদা আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ভোক্তাদের সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। ফ্যাশন শিল্পে ভালো কিছু করার প্রবণতা রয়েছে এবং তারা স্বাস্থ্যকর ও টেকসই কাঁচামাল খুঁজছে। আমরা লাইয়নফিশ থেকে চামড়া তৈরি করা শুরু করি, এবং এভাবেই এই চমৎকার ধারণাটির জন্ম হয়। জাতিসংঘের মতে, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির প্রধান পাঁচটি কারণের মধ্যে আগ্রাসী প্রজাতি অন্যতম, এবং আমি এর সমাধানে কাজ করতে চাই।”
শুরুতে লাইয়নফিশের উপর মনোযোগ দিলেও, ইনভার্সা সিলভারফিন মাছ ব্যবহার করতে শুরু করে। সিলভারফিন হলো চীনের একটি স্থানীয় মাছ, যা ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়েছিল, মূলত পৌরসভার নর্দমায় শৈবাল নিয়ন্ত্রণের জন্য।
কিন্তু এটি দ্রুত বন্য পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। চাভদা বলেন, “মিসিসিপি নদীর বাস্তুতন্ত্রে এটি স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে। এটি প্রচুর পরিমাণে স্থানীয় উদ্ভিদ ও জৈববস্তু খেয়ে ফেলে, এবং বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে একটি বড় সমস্যা।”
এরপর বার্মিজ অজগরের চামড়া ব্যবহারের কাজ শুরু হয়।
চাভদা জানান, “এই সাপটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি constrictor snake, যা ১৯৯০-এর দশকে ফ্লোরিডার এভারগ্লেডসে ছাড়া হয়েছিল। পোষা প্রাণী হিসেবে আনা এই সাপগুলো দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং সেখানকার র্যাকুন, অপোসাম এবং ববক্যাটের মতো স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সংখ্যা কমিয়ে দেয়।”
ইনভার্সা শিকারীদের একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে, যারা আগ্রাসী প্রজাতি সংগ্রহ করে। এরপর তারা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ট্যানিং কারখানায় চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করে।
এই প্রক্রিয়াটি “অরিজিন” নামের একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা বাস্তব সময়ের ডেটা, স্যাটেলাইট চিত্র, পূর্বাভাস মডেলিং এবং এআই-চালিত আক্রমণ ম্যাপিংকে একত্রিত করে।
এর ফলে পুরো কার্যক্রমটি সুসংহত হয় এবং প্রতিটি পণ্যের উৎস চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। চাভদা ব্যাখ্যা করেন, “আমরা শিকার থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, অনুসরণযোগ্য এবং যাচাইযোগ্য একটি সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করছি।”
চাভদা আরও উল্লেখ করেন যে, গরুর চামড়ার প্রক্রিয়াকরণের থেকে এই চামড়া তৈরির পদ্ধতি আলাদা। বিশেষ করে মাছের চামড়ার ক্ষেত্রে, যা খুব পাতলা কিন্তু শক্তিশালী তন্তু দিয়ে গঠিত।
ইনভার্সা বর্তমানে প্রায় ৫০টি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করছে এবং খুব শীঘ্রই আরও প্রজাতির চামড়া তৈরির পরিকল্পনা করছে, যা তারা আগামী বছর ঘোষণা করবে।
কোম্পানিটি তাদের উৎপাদিত পণ্যে হয় তাদের নাম অথবা চামড়াটি আগ্রাসী প্রজাতি থেকে তৈরি হয়েছে, তা উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
তাদের দাবি, এই পদ্ধতিতে চামড়া উৎপাদন কার্বন নিঃসরণ ৮৯% পর্যন্ত কমায় এবং জমির ব্যবহার প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে।
ইনভার্সা জানায়, তারা মানবিক উপায়ে প্রাণী হত্যা করে এবং আমেরিকান অলাভজনক পরিবেশ সংস্থা কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল ও ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর সমর্থন রয়েছে তাদের।
চাভদা জানিয়েছেন, ইনভার্সা ইতিমধ্যে কয়েক হাজার আগ্রাসী প্রাণী অপসারণ করেছে।
যদিও এই অপসারণের ফলে আবাসস্থলের উপর কী প্রভাব পড়েছে, তার সুস্পষ্ট মূল্যায়ন এখনো পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, “এভারগ্লেডসে, আমরা শিকারীদের মাধ্যমে আগ্রাসী প্রজাতি নির্মূলের ফলে স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি।
আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, চাপ কমে যাওয়ায় এটি সাহায্য করছে।”
সুইজারল্যান্ডের বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল (WWF) ইনভার্সার কাজ মূল্যায়ন করে, এটিকে জীববৈচিত্র্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জানায়।
ডব্লিউডব্লিউএফ সুইজারল্যান্ডের সিবিল বর্নার বলেন, “আগ্রাসী প্রজাতি প্রজাতি বিলুপ্তির ৬০% পর্যন্ত অবদান রাখে এবং প্রতি বছর ৪২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি করে, তা সত্ত্বেও সংরক্ষণ তহবিলে এদের প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়।
ইনভার্সার মূল্যায়ন প্রমাণ করে যে, ফ্যাশন কীভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে জীববৈচিত্র্যের জন্য শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে।”
ইনভার্সার এই উদ্যোগের বিষয়ে বুখারেস্টের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিটেকনিকের সহযোগী অধ্যাপক আলেকজান্দ্রা ইয়োনিড বলেন, “আগ্রাসী প্রজাতিকে মূল্যবান উপাদানে পরিণত করা এক সাথে দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে।
এটি স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী প্রজাতিগুলোর কারণে হওয়া পরিবেশগত ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে এবং প্রচলিত চামড়ার আরও টেকসই বিকল্প সরবরাহ করে।
কারিগরিভাবে, আগ্রাসী প্রজাতি থেকে তৈরি চামড়া যে বাস্তব ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় গুণমান অর্জন করতে পারে, তা খুবই উৎসাহজনক।”
তবে, হিউম্যান ওয়ার্ল্ড ফর অ্যানিম্যালসের ফ্যাশন নীতি পরিচালক পিজে স্মিথ বলেছেন, “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় অ-প্রাণঘাতী ব্যবস্থাপনার কৌশল তৈরি করা উচিত, যা বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা মেটানোর পরিবর্তে আগ্রাসী প্রজাতি থেকে নেতিবাচক প্রভাবগুলি মোকাবিলা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সরবরাহ করে।”
পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির ইনভেসিভ স্পিসিজ বায়োলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের সহকারী অধ্যাপক ড. ডিহ লিয়ুরেন্স বলেন, ইনভার্সা যে আগ্রাসী প্রজাতিগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলোর জনসংখ্যা এত বেশি যে, কোম্পানিটি বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান।
তিনি যোগ করেন, “আমি মনে করি, এই ধরনের প্রকল্পের একটি বড় সুবিধা হলো, এটি জৈবিক আগ্রাসনের জটিল সমস্যা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায়।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন