ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের অঙ্গীকার আরও দৃঢ় করতে চাইছে। আগামী সপ্তাহে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য কপ-৩০ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তারা চাইছে নিজেদের মধ্যে একটি সমন্বিত রূপরেখা তৈরি করতে।
ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ইইউ’র ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের মন্ত্রীরা মিলিত হয়ে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় ছিল, কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা।
স্পেনীয় জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী সারা অ্যাগেসেন বৈঠকের শুরুতে বলেন, “আমাদের বিশ্বকে দেখাতে হবে যে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিচ্ছি। বিনিয়োগকারীদের জন্য আমাদের উপযুক্ত সংকেত দিতে হবে। আজকের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
ইইউ দীর্ঘদিন ধরেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ তাদের এই অবস্থানে কিছুটা হলেও চিড় ধরাতে শুরু করেছে।
ইউরোপে দাবানল, তাপপ্রবাহ ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের প্রমাণ। এর ফলে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে ইইউ’র পরিবেশগত নীতিগুলোতে পরিবর্তন আনার চাপ বাড়ছে।
সম্প্রতি, ইউরোপীয় কমিশন বনভূমি ধ্বংস সংক্রান্ত একটি আইনের দুর্বল সংস্করণ তৈরি করেছে, যা পরিবেশবাদীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করছেন, ইইউ কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দের লিয়েন জলবায়ু বিষয়ক অগ্রাধিকারের বিষয়ে আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
যদিও সেপ্টেম্বরে তিনি বলেছিলেন, “জলবায়ু বিষয়ক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব ইউরোপের উপর ভরসা রাখতে পারে।” ২০৪০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৯০ শতাংশ কমানোর অঙ্গীকারও করেন তিনি।
উরসুলা ভন দের লিয়েন জলবায়ু বিষয়ক বিনিয়োগকে সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, একটি স্বনির্ভর ইউরোপ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, সশস্ত্র সংঘাত এবং পরিবেশগত দুর্যোগের মতো হুমকিগুলো আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির পর থেকে অনেক ইইউ সরকার ডানপন্থী অবস্থানে চলে গেছে। তাদের কেউ কেউ জলবায়ু বিষয়ক নিয়মকানুনকে অর্থনীতির জন্য বাধা হিসেবে দেখছেন।
আবার কেউ বলছেন, ইউরোপকে হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরি ও বিক্রি করতে হবে, না হয় চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে জ্বালানি ও সবুজ পণ্য কিনতে বাধ্য হতে হবে।
ইইউ’র জলবায়ু বিষয়ক কমিশনার ওক হোয়েকস্ট্রা বলেছেন, “জলবায়ু বিষয়ক পদক্ষেপকে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা, শিল্প দক্ষতা এবং স্বাধীনতার সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে। সামনের বছরগুলোতে এটিই হবে মূল বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সফল হওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করব, তবে এতে ২৭ জন সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা এবং জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করা ইউরোপকে কিছুটা হতাশ করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক সরকারগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই ইউরোপের জলবায়ু বিষয়ক পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল।
প্যারিস চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা, এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট দূষণ কমাতে হবে।
প্যারিস চুক্তির আওতায় ইইউ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক গাড়িতে বিনিয়োগ করেছে, যা প্রায়ই চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।
জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বায়ুমণ্ডলে তাপ-শোষণকারী কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে, যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি।
এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু আরও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো বাড়ছে।
ইউরোপ হলো বিশ্বের দ্রুততম উষ্ণায়িত মহাদেশ। ১৯৮০ সাল থেকে এখানকার তাপমাত্রা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে বাড়ছে।
এর সঙ্গে তীব্র বৃষ্টিপাত ও বন্যার সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দক্ষিণ ইউরোপে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং খরা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সুইডেনের জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী রোমিনা pourmokhtari ব্রাসেলসে বলেন, “আজকের আলোচনার বিষয় হলো উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজেদের অবস্থানে অবিচল থাকা।”
আগামী ১০ থেকে ২১ নভেম্বর ব্রাজিলের বেলেমে কপ-৩০ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন নতুন পদক্ষেপ এবং অঙ্গীকারের বিষয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস