লিবিয়ার মরুভূমিতে মানব পাচার: শরণার্থীদের জীবন নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের ভয়ঙ্কর চিত্র
উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া, যেখানে মানব পাচারের শিকার হওয়া শরণার্থীদের ওপর চালানো হচ্ছে অকথ্য নির্যাতন। মুক্তিপণের জন্য তাদের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
সম্প্রতি, সিএনএন-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই ভয়ঙ্কর চিত্র।
ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা করা শরণার্থীদের প্রধান ট্রানজিট রুট হলো লিবিয়া। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষগুলো উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমায় এখানে।
কিন্তু তাদের অনেকেরই শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো হয় না। যুদ্ধের বিভীষিকা, নিপীড়ন এবং ভালো জীবনের আশায় ঘর ছেড়ে আসা এই মানুষগুলো লিবিয়ার বিশাল মরুভূমিতে পাচারকারীদের কবলে পরে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানব পাচারকারীরা মূলত সুদানী এবং ইরিত্রিয়ার নাগরিকদের ওপর বেশি অত্যাচার চালায়। নির্যাতনের শিকার হওয়া এই মানুষগুলোর পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
অপহরণকারীদের প্রধান টার্গেট হলো, যে দেশগুলোর অভিবাসীরা তুলনামূলকভাবে ধনী, যেমন – ইরিত্রিয়া।
আফ্রিকার এই দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ওপর নৃশংস অত্যাচারের একটি উদাহরণ হলো আবেবার ভাই ড্যানিয়েল। মুক্তিপণ দিতে না পারায় তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারের কাছ থেকে ১০ হাজার ডলারের বেশি মুক্তিপণ দাবি করা হয়। নির্যাতনের শিকার হওয়া ড্যানিয়েল এখন কোথায় আছে, তা তার পরিবার জানে না।
লিবিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত কুফরা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মরুভূমি পাচারকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেখানে তারা শরণার্থীদের বন্দী করে রাখে এবং পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে।
লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে সীমান্তরক্ষীরা, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলেও বিশাল মরুভূমি এবং তাদের অত্যাধুনিক সরঞ্জামের অভাবে প্রায়ই তারা ব্যর্থ হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিপণের টাকা হস্তান্তরের জন্য পাচারকারীরা “হাওয়ালা” নামক একটি অবৈধ অর্থ লেনদেন পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে, পরিবারগুলো সহজেই তাদের স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাতে পারে, যা কর্তৃপক্ষের পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন।
আল-জাউফ শহরে আটককৃত একজন সুদানী নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তিনি পাচারকারীদের হয়ে মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ এবং বিতরণের কাজটি করতেন। তিনি জানান, নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
ভুক্তভোগীদের উপর নির্যাতনের বীভৎস দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা পরিবারগুলোকে দ্রুত মুক্তিপণ দিতে বাধ্য করে। সিএনএন-এর অনুসন্ধানে জানা যায়, নির্যাতনকারীরা প্রায়ই একটি খামারে আশ্রয় নেয়, যা পুলিশের নজর এড়িয়ে চলে।
কয়েক বছর আগে, তাজিরবু শহরের একটি পুলিশ স্টেশনে পালিয়ে আসা দুজন সুদানী নাগরিক জানায়, তারা একটি খামার থেকে পালিয়ে এসেছে, যেখানে আরও শত শত মানুষকে মুক্তিপণের জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছে। পুলিশের অভিযানে সেখানকার বন্দীদের উদ্ধার করা হয় এবং অপহরণকারী একজন ইরিত্রিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
বন্দীদের মধ্যে থাকা অনেকেই মুক্তি পাওয়ার পর লিবিয়ার কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হয়। এরপর তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সাহায্য চেয়ে দিনের পর দিন বন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে লিবিয়ায় প্রায় এক লক্ষ শরণার্থী নিবন্ধিত আছে। তবে, বাস্তবের সংখ্যা সম্ভবত আরও অনেক বেশি। কারণ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা কেবল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতেই কাজ করতে পারে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ লিবিয়ার সঙ্গে অভিবাসন বিষয়ক চুক্তি করলেও, মানব পাচার বন্ধে তা যথেষ্ট নয়।
আবেবা নামের এক নারীর ভাই ড্যানিয়েলকে মুক্তি দিতে পরিবার শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পাওয়ার পর বর্তমানে তিনি ত্রিপোলিতে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে পরিবারের কাছে এখনো ফিরতে পারেননি।
আবেবা তার ভাইয়ের উপর হওয়া নির্যাতনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “ভগবান যেন তাদের (পাচারকারীদের) শাস্তি দেন। কত মা তাদের সন্তানদের জন্য চোখের জল ফেলছে! আমি বিশ্ববাসীর কাছে এই ঘটনা তুলে ধরার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন