পোকরোভস্ক: ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, রাশিয়ার অভিযানে কতটা ভয়ঙ্কর?

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পোক্রোভস্ক শহরটি সম্ভবত রাশিয়ার সেনাদের দখলে যেতে চলেছে। মাস খানেক ধরে চলা তীব্র লড়াইয়ের পর শহরটির পতন এখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।

পোক্রোভস্কের পতন একদিকে যেমন রাশিয়ার জন্য প্রতীকী বিজয়, তেমনই এর পেছনে রয়েছে বিশাল মূল্য।

সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, পোক্রোভস্কের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক আগেই কমে গিয়েছিল। কিন্তু শহরটি দখল করতে পারলে ২০২৩ সালের মে মাসে বাখমুত দখলের পর এটি হবে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জয়।

সম্প্রতি, রুশ সেনারা শহরে প্রবেশ করতে সক্ষম হওয়ায় সেখানকার লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। যদিও ইউক্রেন দাবি করেছে যে তাদের সেনারা এখনো প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, তবে সেখানকার পরিস্থিতি বেশ কঠিন। শহরের ভেতরে চলছে অবিরাম গোলাগুলি এবং তীব্র যুদ্ধ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার জানিয়েছেন, “আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে গেছি, তবে এতে আমরা অভ্যস্ত।” আরেকজন সেনা সদস্য জানান, রুশ বাহিনী বিপুল সংখ্যক সেনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ইউক্রেনীয় ড্রোন অপারেটররা তাদের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।

রুশ সেনারা প্রায়ই তিন জনের দলবদ্ধভাবে শহরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। তাদের হিসাব হলো, দুই জন মারা গেলেও একজন যেন শহরে প্রবেশ করতে পারে।

পোক্রোভস্কের নিয়ন্ত্রণ এখন আর কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়, বরং এটি একটি প্রতীকী লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার (আইএসডব্লিউ)-এর বিশেষজ্ঞ জর্জ বারোস বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে এর কোনো মানে নেই।”

পোক্রোভস্ক একসময় ইউক্রেনীয় সেনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কেন্দ্র ছিল। এটি ডনেৎস্ক ও কন্সতান্তিনোভকা এবং পশ্চিমে ডিনিপ্রো ও জাপোরিঝিয়ার দিকে যাওয়ার প্রধান সড়ক পথের সংযোগস্থলে অবস্থিত। কিন্তু গ্রীষ্মকালে রাশিয়ার সেনারা শহরটিকে ঘিরে ফেলার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক ও রেলপথে ক্রমাগত ড্রোন ও আর্টিলারি হামলার কারণে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বিকল্প সরবরাহ পথ খুঁজে বের করতে হয়েছে। ফলে পোক্রোভস্কের গুরুত্ব কমে যায়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, পোক্রোভস্কের আক্রমণ জোরদার করতে রাশিয়া প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে।

পোক্রোভস্কের আগে, রাশিয়ার সেনারা ২০২৩ সালের মে মাসে বাখমুত দখল করেছিল। যুদ্ধের আগে শহরটিতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বসবাস করত, তবে রুশ আক্রমণের পর অধিকাংশ মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে।

বর্তমানে সেখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ বেসামরিক লোক আটকা পড়ে আছে।

ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে শহর থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে পোক্রোভস্কের বাসিন্দাদের রাশিয়ার দিকে সরিয়ে নেওয়ার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে।

বিশ্লেষক বারোস বলেছেন, “রাজনৈতিক ও তথ্যগত দৃষ্টিকোণ থেকে পোক্রোভস্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভ্লাদিমির পুতিন বেশ কয়েকবার শহরটি দখলের বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি একটি কৌশলগত তথ্য প্রচারণা চালাচ্ছেন, যার লক্ষ্য হলো—যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার বিজয়কে অনিবার্য হিসেবে তুলে ধরা।”

ইউক্রেনীয় সেনাদের আশঙ্কা হলো, পোক্রোভস্ক হাতছাড়া হওয়ার পর রাশিয়া তাদের দৃষ্টি ডনেৎস্ক অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর দিকে নিবদ্ধ করবে।

ইউক্রেনের ১২৯তম ব্রিগেডের একজন সেনা সদস্য জানিয়েছেন, পোক্রোভস্ক এবং নিকটবর্তী মিরনোহ্রাদ দখলের পর রাশিয়ার সেনারা কন্সতান্তিনোভকার দিকে অগ্রসর হতে পারে। ওই সেনা সদস্য আরও জানান, তাদের ইউনিটে পর্যাপ্ত সেনা নেই এবং সাঁজোয়া গাড়িরও অভাব রয়েছে।

সেনা সদস্যদের উদ্বেগের কারণ হলো, ইউক্রেনীয় নেতৃত্ব সম্ভবত পোক্রোভস্ককে ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কারণ শহরটি হাতছাড়া হলে এটিকে একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হবে।

ওই সেনা সদস্য বলেন, “প্রত্যেকেই যখন পোক্রোভস্কের পতন অনিবার্য বুঝতে পারছে, তখনও শহর ছাড়ার কোনো নির্দেশ নেই। আমাদের একটি সংকীর্ণ পথ দিয়ে পালাতে হবে, এবং আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কত বড় ক্ষতি হতে পারে।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *