যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতিতে ট্রাম্প-স্ট্যানফোর্ড যোগসাজশ: বিতর্ক এবং প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাতে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং “মেক আমেরিকা হেলদি এগেইন” (এমএএইচএ) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে বর্তমানে বেশ আলোচনা চলছে। সম্প্রতি, দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথের (এনআইএইচ) শীর্ষ পদে জয় ভট্টাচার্যের মতো বিতর্কিত ব্যক্তির নিয়োগ এই আলোচনার প্রধান কারণ।
খবর অনুযায়ী, এই পরিবর্তনের ফলে ঐতিহ্যবাহী স্বাস্থ্যখাতে এক ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
২০২২ সালের শুরুতে, স্ট্যানফোর্ড মেডিকেল ছাত্র সান্টিয়াগো সানচেজ, অধ্যাপক জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে একটি বিতর্ক সভার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। অধ্যাপক ভট্টাচার্য্য কোভিড-১৯ লকডাউনের তীব্র বিরোধিতা করে ডানপন্থী মহলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে তেমন উৎসাহ পাওয়া যায়নি।
অনেকের মতে, ভট্টাচার্যের বিতর্ক সভায় অংশগ্রহণের ফলে তার বিতর্কিত মত আরও বেশি প্রচারিত হবে।
বর্তমানে, ভট্টাচার্যের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তিনি এখন এনআইএইচ-এর প্রধান হিসেবে প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেডারেল গবেষণা অনুদান তদারকি করছেন। এই অর্থের একটি অংশ আগে স্ট্যানফোর্ডের জন্য বরাদ্দ ছিল।
এই ঘটনা এমএএইচএ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হল আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সমালোচনা করে স্বাস্থ্য সচেতন আমেরিকানদের একত্রিত করা। এই প্রসঙ্গে, স্ট্যানফোর্ডের প্রাক্তন ছাত্র এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্যোক্তা ক্যাল্লি মিন্স বলেছেন, “যারা বিদ্যমান ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন, তাদের অনেকেই স্ট্যানফোর্ড থেকে এসেছেন, এটি কাকতালীয় নয়।”
স্ট্যানফোর্ডে, এমএএইচএ-র সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়া নিয়ে একদিকে যেমন আনন্দ দেখা গেছে, তেমনই উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ভট্টাচার্যের নিয়োগকে স্বাগত জানালেও, অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। কারণ, এই প্রশাসন ভ্যাকসিন নিরাপত্তা এবং অন্যান্য বিতর্কিত চিকিৎসা পদ্ধতির বিষয়ে প্রশ্ন তোলে।
স্ট্যানফোর্ড মেডিকেল স্কুলের প্রাক্তন ডিন, ফিলিপ পিজ্জো, সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, একাডেমিক গবেষণা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মধ্যেকার বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে, যা জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। গুগল-এর ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন, নেটফ্লিক্সের রিড হেস্টিংস এবং ইন্টেলের প্যাট গেলসিঞ্জারের মতো প্রযুক্তিবিদরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। এই বিষয়ে পিজ্জো বলেন, “স্ট্যানফোর্ডের সংস্কৃতি সবসময় নতুন ধারণা এবং পরীক্ষামূলক চিন্তাভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল।
তবে, কোভিড-১৯ মহামারীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপক স্কট অ্যাটলাস, তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনের বিতর্কিত করোনা-বিষয়ক পদক্ষেপের অন্যতম রূপকার হিসেবে পরিচিত হন। তিনি মাস্ক পরা এবং স্কুল বন্ধ করার মতো পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন এবং “হার্ড ইমিউনিটি” তৈরির পক্ষে ওকালতি করেন।
এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। অনেকে অ্যাটলাসের মতের সমালোচনা করেন। এমনকি, তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগও ওঠে। অন্যদিকে, অধ্যাপক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি দল কোভিড-১৯ প্রতিরোধের কিছু ব্যবস্থার বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
স্ট্যানফোর্ডের অভ্যন্তরে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত স্বাস্থ্য বিষয়ক মতামতকে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সানচেজ মনে করেন, কিছু লোক জবাবদিহিতার বাইরে কাজ করছে এবং এর ফলস্বরূপ, তারা এখন দেশ চালাচ্ছে।
ভাইরাস বিষয়ে গবেষণারত ম্যালরি হ্যারিস বলেছেন, অ্যাটলাস ও ভট্টাচার্যের বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীদের গবেষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা খুবই হতাশাজনক ছিল।
স্ট্যানফোর্ড ইন্টারনেট অবজারভেটরি-র প্রাক্তন গবেষক রেনি ডি-রেস্টা জানিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। ভট্টাচার্যের অভিযোগের কারণে তাঁকে তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে, স্ট্যানফোর্ড ইন্টারনেট অবজারভেটরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর কয়েক মাস পর, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি প্যান্ডেমিক সামিটের আয়োজন করে, যেখানে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক হয়। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করা হলেও, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
স্ট্যানফোর্ডের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোনাথন লেভিন বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীদের ভিন্নমত পোষণকারীদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্ক করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
ট্রাম্প প্রশাসনের স্বাস্থ্য বিষয়ক এজেন্ডায় স্ট্যানফোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই তালিকায় জয় ভট্টাচার্য, কেসি মিন্স, ক্যাল্লি মিন্স, আরমান শর্মা, ব্রুস প্যাটারসন, রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র, জর্জ টিডমার্শ এবং আরও অনেকে রয়েছেন।
এছাড়াও, ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও স্ট্যানফোর্ডের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নিকোল শানাহান, সিমোন গোল্ড, এবং মেরি ট্যালি বোডেন।
তবে, এই প্রভাব বিস্তারের কারণে স্ট্যানফোর্ডকে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফেডারেল সরকার গবেষণার জন্য তহবিল হ্রাস করেছে, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বর্তমানে, স্ট্যানফোর্ডে ভিন্নমত পোষণ করাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অধ্যাপক জেইক স্কট বলেছেন, ভ্যাকসিন সুরক্ষার পক্ষে কথা বলার কারণে তিনি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তাঁর মতে, অনেক শিক্ষক প্রকাশ্যে তাঁদের মতামত জানাতে দ্বিধা বোধ করেন।
অন্যদিকে, অ্যান্ড্রু হাবারম্যানের মতো কিছু ব্যক্তি ভট্টাচার্যের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের হাত ধরে দেশটির স্বাস্থ্যখাতে যে পরিবর্তন আসছে, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি নতুন আলোচনা ও বিতর্কেরও জন্ম হয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন