পুরনো লন্ডনের গুদাম: এক ডিজাইনারের জাদুকরী রূপান্তর!

লন্ডনের পুরনো এক গুদামঘরের নতুন জীবন: এক শিল্পীর ছোঁয়ায়

এক সময়ের ব্যস্ত বন্দর নগরী লন্ডনের ইতিহাস আজও সাক্ষী বহন করে। এককালে, এখানে পণ্য বোঝাই করা জাহাজ ভিড় করত, আর শ্রমিকরা ব্যস্ত থাকতেন চা, তামাক, চাল, ফল, চিনি ও ওয়াইন-এর মত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খালাসের কাজে।

এই কারণে, নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল বিশাল সব গুদামঘর, যেখানে মালামাল সংরক্ষণ করা হত। কালের পরিক্রমায়, এই ঐতিহাসিক গুদামগুলির খুব অল্প কয়েকটাই আজও টিকে আছে।

তবে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেগুলির সংস্কার করা হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকে নিউইয়র্কের ‘লফ্ট অ্যাপার্টমেন্ট’-এর ধারণাকে অনুসরণ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ভেরোনিক হপকিনসন-এর সবসময়ের স্বপ্ন ছিল, লন্ডনের মত ঐতিহাসিক কোনো স্থানে একটি বাড়ি তৈরি করা। অবশেষে, তিনি টেমস নদীর পাশে, গ্রেড-২ তালিকাভুক্ত একটি পুরনো গুদামঘরে তার স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পান।

ওয়াপিং-এ অবস্থিত এই অ্যাপার্টমেন্টটির বারান্দা থেকে নদীর মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। দিনভর এখানে চলে নৌকার আনাগোনা – কোলাহলপূর্ণ পার্টি ক্রুজার, ড্রেজার এবং নৌবাহিনীর টহলদারি বোটের আনাগোনা লেগে থাকে।

জোয়ারের সময় যখন নদীর তলদেশ দৃশ্যমান হয়, তখন অভিজ্ঞ ‘মাডলার্কার’-রা সেখানে মূল্যবান কিছু খুঁজে ফেরে।

ভেরোনিক হপকিনসন-এর ডিজাইন করা এই অ্যাপার্টমেন্টে পুরাতন ও নতুন-এর এক দারুণ মিশ্রণ দেখা যায়। তিনি গুদামঘরের পুরনো কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলি, যেমন – ইটের দেয়াল এবং কারখানার পুলির ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

এর সাথে যোগ করেছেন আধুনিক আসবাবপত্র, যা স্থানটিকে দিয়েছে রুচিশীলতার ছোঁয়া।

এই অ্যাপার্টমেন্টটিকে সাজাতে গিয়ে, হপকিনসন প্রথমে দুটি তলার সমস্ত ঘর ভেঙে একটি বিশাল খোলা জায়গা তৈরি করেন, যেখানে থাকবে লিভিং, ডাইনিং ও রান্নাঘর।

তার স্বামী ব্র্যাডলি একজন ভালো রাঁধুনি। তাই রান্নাঘরটি এই বাড়ির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

রান্নাঘরের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৩ মিটার লম্বা একটি ইস্পাতের তৈরি দ্বীপ, যার চারপাশে বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

এই দ্বীপটি তৈরি করতে হপকিনসনের ‘শিল্পসম্মত অন্দরসজ্জা’র ধারণা অনুসরণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে মানানসই ইস্পাতের তৈরি অন্যান্য সরঞ্জাম, কংক্রিটের ব্যাকস্প্ল্যাশ, এবং ‘অ্যান্ড্রু মার্টিন’-এর আকর্ষণীয় আলো এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

রান্নার জায়গার পাশেই রয়েছে একটি ছোট, গোপন স্থান, যেখানে দুটি ডিশওয়াশার বসানো হয়েছে।

হপকিনসন তার বাড়ির প্রবেশপথ এবং সিঁড়ি নতুন করে সাজিয়েছেন, যাতে আরও বেশি জায়গা পাওয়া যায় এবং স্টোরেজের ব্যবস্থা করা যায়।

এছাড়াও, তিনি একটি হোম অফিস তৈরি করেছেন, যা মূল স্থান থেকে ‘ক্রিটাল গ্লাস প্যানেল’-এর মাধ্যমে আলাদা করা হয়েছে।

এই প্যানেলগুলো তৈরি করার সময় ভিক্টোরিয়ান যুগের জানালাগুলোর নকশা অনুসরণ করা হয়েছে, যা ঘরের ভেতর পর্যাপ্ত আলো সরবরাহ করে।

ভেরোনিক হপকিনসন গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং বিজ্ঞাপন সংস্থাও চালান। তিনি তার ইন্টেরিয়র ডিজাইন-এর কাজকে একটি বিজ্ঞাপন প্রচারণার সঙ্গে তুলনা করেন।

তার মতে, “উভয় ক্ষেত্রেই ভিজ্যুয়াল উপাদান নির্বাচন করতে হয়, লক্ষ্য শ্রোতাদের কথা মাথায় রাখতে হয় এবং বাজেট ও সময়সীমা মেনে কাজ করতে হয়।”

লিভিং রুমে রাখা হয়েছে ‘অ্যান্ড্রু মার্টিন’-এর কার্পেট, সিয়াটল থেকে আনা বাদামী চামড়ার সোফা, ‘টিমোথি ওল্টন’-এর তৈরি চামড়ার আর্মচেয়ার এবং একটি বিশাল ভাস্কর্য।

হপকিনসন তার ডিজাইন শৈলীকে “কার্যকরী এবং খাঁটি” হিসেবে বর্ণনা করেন। তার মতে, “আলো একটি শিল্পসম্মত পরিবেশে আরাম তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”

এই বাড়িতে আরও রয়েছে এটসিতে কেনা পুরনো সাইনবোর্ড, একটি পুরাতন জুকবক্স, নটিং হিল মার্কেট থেকে সংগ্রহ করা চামড়ার পাঞ্চিং ব্যাগ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা কাঠের মূর্তি ও মুখোশ।

হপকিনসন ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের দুটি মেয়ে এবং দুটি পোষা কুকুরের সাথে এই বাড়িতে বসবাস করেন।

ডাইনিং রুমে ইউক্রেনীয় শিল্পী মাইকোলা কুরিইউক-এর আঁকা একটি বিশাল ক্যানভাস উজ্জ্বলতা যোগ করেছে। এখানে ধাতব শেলফ ও ধাতব বাক্স দিয়ে তৈরি ওয়াইন র‍্যাকও রয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা কাঠের টেবিল ও বেঞ্চের উপর ‘টিমোথি ওল্টন’-এর তৈরি একটি টিউব আকৃতির লাইট স্থাপন করা হয়েছে।

উপরের মাস্টার বেডরুমে, কাঠের তৈরি একটি আফ্রিকান যুদ্ধ মুখোশ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানে ‘ওকা’ কার্পেট এবং কুশন-এর সাথে একটি বিমানের নকশার ধাতব ফ্রেমযুক্ত বিছানা স্থাপন করা হয়েছে।

বারান্দায় রাখা হয়েছে ‘আইকেয়া’র চেয়ার, যেখান থেকে ইংল্যান্ডের দীর্ঘতম নদীর শান্ত প্রবাহ উপভোগ করা যায়।

হপকিনসন বলেন, “ওয়াপিং একটি দারুণ এলাকা। এখানকার স্থানীয় দোকান ও কসাইখানার কারণে জায়গাটা অনেকটা গ্রামের মতো।

কুকুরদের হাঁটাতে নিয়ে গেলে এখানকার মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।”

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *