মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী সম্প্রতি ইয়েমেনে বিমান হামলা চালিয়েছে, যাতে অন্তত ৩২ জন নিহত হয়েছে এবং ১০১ জন আহত হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।
জানা গেছে, গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া এই হামলা রবিবার ভোর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া খবরে প্রকাশ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল-সংযুক্ত জাহাজের ওপর হামলার হুমকি দেওয়ার প্রেক্ষিতে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই ব্যাপক হামলার নির্দেশ দেন। গাজায় ইসরায়েলের অবরোধের প্রতিক্রিয়ায় হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েল-সংযুক্ত জাহাজে পুনরায় হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছিল।
এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০টি বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগই ইয়েমেনের রাজধানী সানার উত্তরে অবস্থিত সাদা প্রদেশে চালানো হয়েছে। ইয়েমেনি গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মার্কিন বাহিনী নিম্নলিখিত স্থানগুলোতে হামলা চালিয়েছে।
হুতিরা ‘আনসার আল্লাহ’ নামেও পরিচিত, যার অর্থ ‘আল্লাহর সমর্থক’। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি ইয়েমেনের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে রাজধানী সানাও অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, তারা দেশটির পশ্চিমাঞ্চল এবং সৌদি আরবের কাছাকাছি কিছু এলাকারও নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রেখেছে।
১৯৯০-এর দশকে হুতিদের উত্থান হয়, তবে ২০১৪ সালে তারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, যখন তারা তৎকালীন ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এর ফলস্বরূপ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং দেশটিতে ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়।
এরপর থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, শিয়া এই গোষ্ঠীটিকে শুধুমাত্র ইরানের সহযোগী হিসেবে দেখা উচিত নয়। তাদের নিজস্ব ভিত্তি, স্বার্থ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
বর্তমানে হুতিরা ইয়েমেনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে রাজধানী সানাও রয়েছে। অন্যদিকে, ইয়েমেনি সরকার দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে তাদের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে আদেন শহর অবস্থিত।
এই হামলাগুলো এমন এক সময়ে সংঘটিত হলো, যখন ইয়েমেনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলের অবরোধের প্রতিবাদে লোহিত সাগরে ইসরায়েল-সংযুক্ত জাহাজগুলোতে পুনরায় হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। যদিও গত সপ্তাহে হামলার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও, হুতিরা এখনো কোনো জাহাজে আক্রমণ চালায়নি।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে, হুতিরা ইয়েমেনের উপকূলের কাছাকাছি জাহাজগুলোর ওপর বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। গোষ্ঠীটি দাবি করে, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্রের মতে, ২০২৩ সাল থেকে হুতিরা মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর ওপর ১৭৪ বার এবং বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর ১৪৫ বার হামলা চালিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কার্যক্রম তদারকি করা ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড শনিবারের হামলাকে ‘ইয়েমেনে বৃহত্তর অভিযানের শুরু’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
কর্মকর্তাদের মতে, এই হামলাগুলো আংশিকভাবে লোহিত সাগরে অবস্থান করা হ্যারি এস ট্রুম্যান বিমানবাহী রণতরী থেকে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে চালানো হয়েছে।
আগের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বেশ কয়েকটি হামলা চালায়। তাদের দাবি ছিল, এসব হামলা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে।
এছাড়াও, ইসরায়েলও একাধিকবার ইয়েমেনের অবকাঠামো, যেমন – সান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর হামলা চালিয়েছে।
লোহিত সাগর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ, যেখান দিয়ে বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ পণ্য পরিবহন করা হয়। সুয়েজ খাল এবং বাব-আল-মান্দেব প্রণালী হলো উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের চালান পরিবহনের প্রধান কেন্দ্র, যা বিশ্বে সমুদ্রপথে বাণিজ্যিকভাবে যাওয়া মোট তেলের ১২ শতাংশ এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ৮ শতাংশ সরবরাহ করে।
শুধু বাব-আল-মান্দেব প্রণালী দিয়েই ২০২৩ সালে প্রতিদিন গড়ে ৮.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ৪.১ বিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে। এটি বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
লোহিত সাগরের বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ‘গুড হোপেরCape’ হয়ে সমুদ্রপথে যাওয়া যেতে পারে। তবে এই পথটি অনেক বেশি দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল।
বিশেষ করে উপসাগর থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা