ফরাসি চিত্রশিল্পী পল গঁগ্যাঁ-র জীবন ও কর্ম নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিতর্কিত এই শিল্পীর জীবন নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি নতুন জীবনীগ্রন্থ, যেখানে তার সম্পর্কে প্রচলিত অনেক ধারণার ভিন্ন চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষ করে পলিনেশীয় নারীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে নতুন তথ্য উঠে এসেছে, যা শিল্পী-মহলে সাড়া ফেলেছে।
গঁগ্যাঁ-র জীবন ছিল নানা রঙে ভরপুর। ১৮৪৮ সালে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ১৯০৩ সালে মারা যান।
পেরুতে শৈশব কাটানোর পর তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন এবং পরবর্তীতে তাহিতি ও হিউয়া-ও-এর মতো পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করেন। তার জীবনের এই সময়গুলোই তার শিল্পকর্মে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
গঁগ্যাঁ-র বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি যৌনরোগ (সিফিলিস) ছড়িয়েছেন এবং নাবালিকাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। নতুন জীবনীর তথ্যানুসারে, গঁগ্যাঁ-র শরীরে সিফিলিসের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এমনকি, তার পলিনেশীয় সঙ্গীনীদের বয়সও সে সময়ের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যথেষ্ট ছিল। জীবনীকারদের দাবি, তিনি স্থানীয় রীতিনীতি মেনেই সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
গবেষকরা গঁগ্যাঁর দাঁত পরীক্ষা করে দেখেন, যেখানে পারদ, আর্সেনিক বা ক্যাডমিয়ামের মতো সিফিলিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কোনো উপাদানের চিহ্ন ছিল না। এছাড়াও, তাহিতিতে তার চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, গঁগ্যাঁ-র আসল রোগ ছিল একজিমা ও এরিসিপেলাস, যা পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে বেড়ে গিয়েছিল।
গঁগ্যাঁর সবচেয়ে পরিচিত সঙ্গিনী ছিলেন তেহামানা। জানা গেছে, তেহামানার জন্মসনদ অনুযায়ী, তার বয়স ছিল ১৫ বছর।
সে সময় ফরাসি উপনিবেশগুলোতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ছিল ১৩ বছর। গঁগ্যাঁ-র সঙ্গে তেহামানার সম্পর্ক ছিল স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী। সেখানে মেয়েদের পরিবারই তাদের পছন্দের পুরুষদের কাছে পাঠাতো।
সম্পর্কগুলো ছিল পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে, যেখানে কোনো প্রকার জোর-জবরদস্তি ছিল না।
গঁগ্যাঁ-র আঁকা ছবিগুলোও নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মানাও tupapau’ বা ‘আত্মার উপস্থিতি’ (Spirit of the Dead Watching)-এর মাধ্যমে তিনি তেহামানার ভেতরের ভয় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
এই ছবিতে তেহামানাকে নগ্ন অবস্থায় দেখানো হয়েছে, যা অনেকের কাছে বিতর্কিত মনে হতে পারে। তবে গঁগ্যাঁর ভাষ্য ছিল, তিনি তেহামানার রাতের ভয়ের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
গঁগ্যাঁর আরেকটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘ইয়াওরানা মারিয়া’ বা ‘শুভ সকাল মারিয়া’ (Ia Orana Maria) নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
এই ছবিতে পলিনেশীয় এক নারীর কোলে যিশুর ছবি আঁকা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে শ্বেতাঙ্গ নয় এমন কোনো মানুষের পবিত্র পরিবারের ছবি আঁকা ছিল কল্পনাতীত।
গঁগ্যাঁ ফরাসি উপনিবেশের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
তিনি স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি করতেন এবং নিজের পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে ফরাসি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবিচারের চিত্র তুলে ধরা হতো।
তিনি প্যারিসের সরকারের কাছেও ন্যায্য কর ও আচরণের আবেদন জানিয়েছিলেন।
হিউয়া-ও-তে বসবাস করার সময় গঁগ্যাঁ স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
তিনি সেখানকার শিশুদের ফরাসি ক্যাথলিক স্কুলে পাঠানো এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার সরকারি নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
সেখানকার অধিবাসীরা তাকে এতটাই সম্মান করতেন যে, তারা তাদের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
গঁগ্যাঁ-কে ফরাসি কর্তৃপক্ষ সবসময় সন্দেহের চোখে দেখত। একবার এক জেন্ডার্মকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করার পর তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়।
যদিও পরে গঁগ্যাঁর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছিল, ততদিনে তিনি মারা যান।
গঁগ্যাঁ-র জীবনী ‘ওয়াইল্ড থিং’ (Wild Thing) লিখেছেন সু প্রাইডক্স। বইটিতে গঁগ্যাঁর জীবনের অজানা অনেক দিক তুলে ধরা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান