যুদ্ধবিধ্বস্ত ডিআরসি-র খনিজ সম্পদের লোভে কি ট্রাম্পের দ্বারস্থ?

গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি) : খনিজ সম্পদের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা চাইছে কঙ্গো কঙ্গোতে চলমান সংঘাতের মধ্যে খনিজ সম্পদের বিনিময়ে নিরাপত্তা চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে দেশটির সরকার।

এমনটাই জানা গেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের করা চুক্তির আদলে কঙ্গো সরকারও চাইছে এমন একটি পদক্ষেপ নিতে।

পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে বিদ্রোহীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, বিশেষ করে দেশটির পূর্বাঞ্চলে, যেখানে প্রচুর খনিজ সম্পদ রয়েছে। এম২৩ নামের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইতোমধ্যে সেখানকার কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছে।

এই অঞ্চলের খনিজগুলোর মধ্যে রয়েছে সোনা ও কোবল্ট, যা ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কঙ্গো সরকারের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও কয়েক হাজার।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও কঙ্গোর মধ্যে প্রস্তাবিত চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, কঙ্গো সরকার চাইছে বিদ্রোহীদের দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা।

বিনিময়ে খনিজ সম্পদ ব্যবহারের অধিকার দিতে পারে তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে এমন জোট কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এমন চুক্তিতে ওয়াশিংটন সরাসরি সেনা সহায়তা না দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ‘সিগন্যাল রিস্ক’-এর বিশ্লেষক ড্যানিয়েল ভ্যান ডালেন বলেন, “এমন চুক্তির সবচেয়ে সম্ভাব্য দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সেনা সহায়তা না করে কঙ্গোকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে।”

কঙ্গোর এই প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট হলো, ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব। যেখানে ইউক্রেন তার খনিজ সম্পদের ৫০ শতাংশ অধিকার দেবে এবং এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা করবে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স-সিশেকেদির চিফ অফ স্টাফের ডেপুটি আন্ড্রে ওয়ামেসো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন একটি সম্ভাব্য ‘পার্টনারশিপ’ নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি মাসের শুরুতে ওয়াশিংটন সফর করেছেন।

কঙ্গো কর্তৃপক্ষ এখনো চুক্তির বিস্তারিত জানায়নি। ইউক্রেনের মতোই কঙ্গোও এম২৩ এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিরাপত্তা সহযোগী চাইছে।

কঙ্গোর খনিগুলোতে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই দেশ টিন, টাংস্টেন, ট্যানটালাম এবং সোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উৎপাদন করে।

এই খনিজগুলো একত্রে ‘3TG’ নামে পরিচিত এবং ইলেকট্রনিকস, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও অন্যান্য প্রযুক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হয়, কঙ্গোর এই অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আফ্রিকা বিজনেস কাউন্সিল নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ২১শে ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিওকে একটি চিঠি লিখে কঙ্গোর অনাবিষ্কৃত সম্পদে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে।

তারা কঙ্গোর সিনেটের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষা বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর পিয়েরে কান্ডা কালাম্বায়ির পক্ষে এই প্রস্তাব দেয়। তাদের প্রস্তাব ছিল, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের বিনিময়ে এই বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে জানান, কঙ্গো উন্নত প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধারণ করে এবং এই খাতে অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।

তবে, তারা কঙ্গোতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে চায়, যা হবে স্বচ্ছ ও দায়িত্বপূর্ণ। কঙ্গোতে গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির দুর্বল সামরিক বাহিনীর কারণ হলো সরকারের দুর্নীতি। ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে দেশটি দুটি গৃহযুদ্ধ এবং এম২৩ বিদ্রোহীদের সঙ্গে বর্তমান বিদ্রোহের শিকার হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স-সিশেকেদির প্রধান লক্ষ্য হলো এম২৩ গোষ্ঠীকে পরাজিত করা। বর্তমানে দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন (Monusco) সহ বেশ কয়েকটি শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।

এম২৩ ইতোমধ্যেই গোমা ও বুকাভুসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করেছে এবং তারা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ কেন্দ্র ওয়ালিকালেও প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, প্রতিবেশী রুয়ান্ডার সঙ্গে বিরোধ এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।

জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই রুয়ান্ডার বিরুদ্ধে এম২৩ কে সমর্থন এবং অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ এনেছে। তাদের আরও অভিযোগ, এম২৩ গ্রুপ কঙ্গো থেকে সোনা, কোবল্ট ও অন্যান্য খনিজ পাচার করছে।

রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে এম২৩ এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে এম২৩ এর খনি দখলের মাধ্যমে আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রুয়ান্ডার সঙ্গে ৩টিজি খনিজ সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা বাতিলের কথা বিবেচনা করছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ ট্যানটালাম সরবরাহ করে রুয়ান্ডা।

ইইউ-এর কঙ্গোর সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি রয়েছে। সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ রুয়ান্ডার কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যাদের বর্তমান সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

তারা কাগামের সরকারকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কঙ্গো সরকারের মালিকানাধীন খনিজগুলোতে সরাসরি প্রবেশাধিকার পেলে ওয়াশিংটন উপকৃত হবে।

কঙ্গোর সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা চীনের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য খনিজ বিষয়ক বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছিলেন, তবে সেগুলো স্বচ্ছতা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত হয়েছিল।

বর্তমানে, চীনের কোম্পানিগুলো কঙ্গোর খনিজ শিল্পে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে। কোবাল্ট খনির বৃহত্তম নয়টি অঞ্চলের মধ্যে অর্ধেকই চীনা কোম্পানি পরিচালনা করে।

প্রেসিডেন্ট সিশেকেদির আমলে, কঙ্গো সরকার চীন থেকে সরে এসে অন্যান্য দেশকেও খনি মালিকানা ও পরিচালনার সুযোগ দিতে চাইছে। গত দুই বছরে কঙ্গো ইইউ ও ভারতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

কঙ্গোর মুখপাত্র প্যাট্রিক মুয়ায়া রয়টার্সকে জানান, তার দেশ ‘বৈচিত্র্য’ আনতে প্রস্তুত এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হবে। তবে বিশ্লেষক ভ্যান ডালেন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কঙ্গোর খনিগুলোর মালিকানা নেওয়ার সম্ভাবনা কম।

কারণ, সেক্ষেত্রে তারা চীনের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, “আমি এমন কোনো পরিস্থিতি দেখছি না, যেখানে কোনো চুক্তির ফলে নিকট ভবিষ্যতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে অথবা এই খাতে চীনের আধিপত্য কমবে।”

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সরকারের কাছ থেকে সরাসরি খনিজ কেনা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। এর ফলে চীন খনি পরিচালনা করতে থাকবে এবং এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্ভাবনাও কমবে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও কঙ্গোর মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তবে ট্রাম্পের আমলে ইউক্রেন আলোচনার মতো বিষয়গুলো আরও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও কঙ্গোতে কোনো মার্কিন কোম্পানি কাজ করছে না, যুক্তরাষ্ট্র ‘লোবিটো করিডোর’ নামে একটি অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যার মধ্যে রয়েছে কঙ্গোর খনিজ সম্পদ প্রতিবেশী অ্যাঙ্গোলার মাধ্যমে রপ্তানির জন্য রেলপথ ও বন্দর নির্মাণ।

তথ‌্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *