যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র গবেষণা খাতে বড় ধরনের কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের উপরও।
দেশটির ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রে (NOAA)-এ কর্মরত এক হাজারের বেশি বিজ্ঞানীকে সম্প্রতি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে চরম ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একটা সময়ে এই ছাঁটাইগুলো করা হলো, যখন সমুদ্রগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। গত বছর ও এ বছর (২০২৩-২৪) টানা প্রায় ৪৫০ দিন ধরে সমুদ্রের তাপমাত্রা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, যা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়াচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি করছে।
এর ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রবাল প্রাচীরগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সংস্থা NOAA-এর প্রধান কাজ হলো সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করা। ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হলেন হিদার ওয়েলচ।
তিনি প্রায় এক দশক ধরে NOAA-তে কাজ করেছেন এবং সামুদ্রিক প্রাণীর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করতেন। জাহাজের নাবিকদের জন্য সমুদ্রপথে দিকনির্দেশনা তৈরি এবং মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ।
কিন্তু ছাঁটাইয়ের ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এখন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, NOAA-এর বিজ্ঞানীদের ছাঁটাইয়ের ফলে সমুদ্র বিষয়ক গবেষণার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলস্বরূপ, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে, যা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনহানির ঝুঁকি বাড়াবে।
এছাড়া, সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘ভিব্রিয়ো’ নামক মাংসখেকো ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বাড়ছে, যা মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়লে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এবং যারা সামুদ্রিক খাবারের উপর নির্ভরশীল, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়বে।
অন্যদিকে, এল নিনো এবং লা নিনার মতো প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাগুলো পর্যবেক্ষণেও এই ছাঁটাই একটি বড় বাধা সৃষ্টি করবে। প্রশান্ত মহাসাগরে উৎপন্ন হওয়া এই দুটি ঘটনার প্রভাব বিশ্বজুড়ে অনুভূত হয় এবং এর কারণে আবহাওয়ার ধরনে বড় পরিবর্তন আসে।
NOAA-এর পূর্বাভাস আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রভাব ফেলে। তাই, কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়লে তা বিভিন্ন দেশের জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের ফলে অন্যান্য দেশগুলো, বিশেষ করে চীন, সমুদ্র গবেষণায় তাদের বিনিয়োগ আরও বাড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের ক্ষমতা কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সমুদ্র গবেষণা খাতে নেতৃত্ব হারাতে পারে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র এবং উপকূলীয় অঞ্চলে আগামী চার বছরে আরও বেশি দুর্যোগ দেখা দিতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন। তরুণ বিজ্ঞানীদের ছাঁটাইয়ের ফলে দীর্ঘমেয়াদেও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
কারণ, সমুদ্র অর্থনীতিতে খাদ্য ও পরিচ্ছন্ন শক্তি খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তরুণ বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো।
বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে হয় বাংলাদেশকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র গবেষণা দুর্বল হয়ে পড়লে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। তাই, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
তথ্য সূত্র: সিএনএন