আফ্রিকার ‘গ্যালাপাগোস’, যেখানে মানুষ কম, প্রকৃতির রূপ বেশি!

আফ্রিকার একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র, সাও তোমে ও প্রিন্সিপে, যা জীববৈচিত্র্যের এক অসাধারণ ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। একে ‘আফ্রিকার গ্যালাপাগোস’ও বলা হয়। পর্যটকদের কাছে এখনো খুব একটা পরিচিত না হলেও, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর পরিবেশ সচেতন পর্যটন উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশটি।

এই দ্বীপপুঞ্জ কিভাবে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে পারে, সেই গল্প নিয়েই আজকের আলোচনা।

গ্যাবন উপকূল থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে অবস্থিত এই দ্বীপগুলি, পর্তুগিজদের হাত ধরে পরিচিতি লাভ করে। একসময় এখানকার অর্থনীতি ছিল চিনি ও কোকো চাষের উপর নির্ভরশীল।

১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এমনকি ২০১০ সালে বেকারত্বের হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।

ঠিক সেই সময়ে, প্রিন্সিপে দ্বীপের উত্তরে পাম তেল উৎপাদনের জন্য প্রায় আড়াই হাজার একর জমি ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়। তবে, স্থানীয় সরকার এবং পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করেন।

তাঁরা পরিবেশ ও সংস্কৃতির উপর এর সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন। এর পরিবর্তে, তাঁরা দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোক্তা মার্ক শাটলওয়ার্থের সঙ্গে হাত মেলান।

শাটলওয়ার্থ মূলত একটি আকর্ষণীয় অবকাশ যাপনের স্থান খুঁজছিলেন এবং প্রিন্সিপে ছিল তার জন্য আদর্শ। এখানে তিনি প্রচলিত রিসোর্ট বানানোর পরিবর্তে টেকসই পর্যটন এবং কৃষি-বনসৃজনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নতির পরিকল্পনা করেন।

শাটলওয়ার্থের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি, এইচবিডি প্রিন্সিপে (HBD Príncipe), বর্তমানে দ্বীপের বৃহত্তম নিয়োগকর্তা। তাদের অধীনে রয়েছে চারটি রিসোর্ট – প্রিন্সিপে কালেকশন।

এছাড়াও, তারা ‘প্যাসিয়েন্সিয়া অর্গানিক’ নামে একটি কোকো খামার পরিচালনা করে, যেখানে চকোলেট ও সৌন্দর্য্য সামগ্রী উৎপাদন করা হয়।

এখানকার সবচেয়ে বিলাসবহুল রিসোর্ট হল সান্ডি প্রেইয়া। এছাড়াও, বোম বোম হল তাদের প্রথম হোটেল, যা পাঁচ বছর সংস্কারের পর পুনরায় খোলা হয়েছে।

আর ‘রোকা সান্ডি’ পর্যটকদের দ্বীপের চকোলেট তৈরির অভিজ্ঞতা দেয়। সাও তোমের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত ‘ওমালি’ হল এইচবিডি-র আরেকটি আকর্ষণ।

গত ১৫ বছরে, এইচবিডি প্রিন্সিপে দ্বীপটিতে ১০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে সাও তোমের মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তারা।

স্থানীয় গাইড উইলবার তাভারেস জানান, “এক দশক আগেও যখন শ্বেতাঙ্গরা এখানে আসত, স্থানীয়রা তাদের ভালোভাবে নিতো না, কারণ অতীতে খারাপ অভিজ্ঞতা ছিল। এখন নতুন প্রজন্ম সবকিছু ভালোভাবে গ্রহণ করতে শিখেছে।”

২৭ বছর বয়সী তাভারেসের মতো স্থানীয় তরুণরা মনে করেন, এইচবিডি এবং পর্যটন শিল্পের কারণে তাদের আর কাজের খোঁজে বিদেশ যেতে হবে না। এইচবিডি-র বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের জন্য সবসময়ই বিদ্যমান।

এই কোম্পানি প্রতিটি রাতের জন্য ২৬ ডলার ফি নেয়, যা প্রিন্সিপে ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় সংরক্ষণ ও সামাজিক কল্যাণমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে সরাসরি ব্যবহৃত হয়।

এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় প্রবাল প্রাচীর পর্যবেক্ষণ, সমুদ্র কচ্ছপের বাসা পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান।

২০২৪ সালে এইচবিডি তাদের কমিউনিটি সমর্থন আরও বাড়িয়েছে। তারা ‘ন্যাচারাল ডিভিডেন্ড’ নামে একটি নতুন ফাউন্ডেশন তৈরি করেছে, যা দ্বীপবাসীকে পরিবেশ সংরক্ষণে উৎসাহিত করার জন্য আর্থিক সহায়তা করে।

এই প্রকল্পের প্রধান জর্জে আলকোবিয়া বলেন, “এটা অনেকটা সর্বজনীন মৌলিক আয়ের মতো। যারা প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখতে স্বেচ্ছায় কাজ করতে চায়, আমরা তাদের অর্থ প্রদান করব।”

আলকোবিয়া আরও জানান, এই প্রকল্পের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল এমন একটি মডেল তৈরি করা, যা অন্যান্য গন্তব্য অনুসরণ করতে পারে। তাদের এই প্রচেষ্টা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে।

টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার এমন সমন্বিত উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিকে কাজে লাগিয়ে, পরিবেশের ক্ষতি না করে কীভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো যায়, সাও তোমে ও প্রিন্সিপের অভিজ্ঞতা থেকে তা শেখার সুযোগ রয়েছে।

তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *