আফ্রিকার মুক্তি: সাহায্যের বদলে খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ!

আফ্রিকার খনিজ সম্পদ: উন্নয়নের চাবিকাঠি নাকি বিদেশি সাহায্যের ফাঁদ?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য বন্ধের সিদ্ধান্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, আফ্রিকার দেশগুলোতে এর প্রভাব বেশ গুরুতর হতে পারে।

এক হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID)-এর মাধ্যমে পাওয়া সাহায্য আফ্রিকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং স্যানিটেশন সহ বিভিন্ন খাতে ব্যয়িত হতো। কিন্তু সাহায্য নির্ভরতার এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে।

আফ্রিকা মহাদেশে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার, যা ভবিষ্যতের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (Democratic Republic of the Congo) একাই সরবরাহ করে বিশ্বের ৭০ শতাংশ কোবাল্ট, যা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির জন্য অপরিহার্য।

দক্ষিণ আফ্রিকা যোগান দেয় ৭৫ শতাংশ প্ল্যাটিনাম এবং ৫০ শতাংশ প্যালাডিয়াম। মোজাম্বিক ও মাদাগাস্কারে রয়েছে বিশাল গ্রাফাইটের ভাণ্ডার, আর জিম্বাবুয়েতে রয়েছে সিজিয়াম, যা জিপিএস এবং 5জি প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এই খনিজ সম্পদ শুধু পাথর বা ধাতু নয়, বরং বিশ্বজুড়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিটি বৈদ্যুতিক গাড়ি, সৌর প্যানেল, এবং বায়ু টারবাইন তৈরি হয় আফ্রিকার প্রচুর পরিমাণে থাকা খনিজগুলির উপর নির্ভর করে।

কিন্তু এই মূল্যবান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, আফ্রিকা আজও সেই সব দেশগুলির কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতে, যারা তাদের খনিজ সম্পদ থেকে লাভবান হচ্ছে।raw cobalt প্রতি কেজি ২৬-৩০ ডলারে বিক্রি হয়, যেখানে প্রক্রিয়াকরণের পর ব্যাটারি-গ্রেডের কোবাল্ট ১৫০-২০০ ডলারে বিক্রি হয়।

অর্থাৎ, আফ্রিকার উৎপাদিত খনিজ সম্পদের ৮০ শতাংশেরও বেশি মূল্য তারা হারাচ্ছে।

বৈশ্বিক ব্যাটারি বাজার ২০৩০ সাল নাগাদ ২৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ-এর চাহিদা বছরে ২৬ শতাংশ হারে বাড়ছে।

আফ্রিকার খনিজ সম্পদ নিঃসন্দেহে তাদের প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্তে, তারা এখনো বৈদেশিক সাহায্য কিভাবে পাওয়া যায় সেই চিন্তায় ব্যস্ত।

অনেকে হয়তো বলবেন, আফ্রিকার এই সব খনিজ সম্পদ প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, বিশেষজ্ঞ এবং মূলধনের অভাব রয়েছে। আপাতত তাদের কথা হয়তো সত্যি।

তবে, এই দুর্বলতা দূর করতে না পারলে ভবিষ্যতে আফ্রিকার উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়বে। চীন এই বিষয়টি অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল।

তারা আফ্রিকার খনিজ সরবরাহ শৃঙ্খলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

এই সমস্যার সমাধানে জটিল কিছু নেই। প্রয়োজন অবকাঠামো তৈরি করা, শুধু খনিজ উত্তোলনের স্থান তৈরি করলেই হবে না, বরং প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করতে হবে, যেখানে খনিজ সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি উন্নত করা যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আঞ্চলিকভাবে চিন্তা করা।

উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকান উন্নয়ন সম্প্রদায়ের (Southern African Development Community) দেশগুলো একত্রিত হয়ে ব্যাটারি তৈরির একটি উদ্যোগ নিতে পারে, যেখানে দেশগুলো তাদের সম্পদ এবং প্রযুক্তি একত্রিত করে সমন্বিত ভ্যালু চেইন তৈরি করবে।

অথবা, পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো মিলে বিরল মৃত্তিকা উপাদান (Rare Earth Elements) নিয়ে একটি সহযোগিতা কাঠামো তৈরি করতে পারে, যা তাদের খনিজ সম্পদকে উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদন ক্ষমতার দিকে নিয়ে যাবে।

কেউ কেউ পরিবেশ দূষণের কথা তুলে ধরবেন। খনিজ উত্তোলনে যে পরিবেশের ক্ষতি হয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

তবে এর সমাধান হলো, খনিজ সম্পদ উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া নয়, বরং পরিবেশ সুরক্ষার উপযুক্ত মানদণ্ড তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা।

এর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব, সেই সাথে স্থানীয় মানুষের উপকারও হবে। অন্যথায়, বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করবে, আর তার ফল ভোগ করতে হবে স্থানীয়দের।

বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এইচআইভি (HIV) চিকিৎসার কর্মসূচি, শিক্ষা প্রকল্প, খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প—এগুলো এখন ঝুঁকির মুখে।

তবে, এই প্রোগ্রামগুলো যদি অপরিহার্য হয়, তাহলে কেন আমরা বিদেশি সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছের ওপর নির্ভর করব?

আমাদের খনিজ সম্পদ থেকে আমরা যদি পুরোটা মূল্য পেতে পারি, তবে এই প্রোগ্রামগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব।

এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সাহস এবং একটি অভিন্ন লক্ষ্য। এমন নেতৃত্ব দরকার যারা আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে না থেকে, আফ্রিকার উন্নয়নের পরিকল্পনা করবে।

এমন ব্যবসায়ী দরকার যারা শুধু রফতানি কেন্দ্র তৈরি না করে, প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র তৈরি করবে। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার, যেখানে প্রকৌশলী এবং ধাতুবিদ তৈরি হবে, যারা সাহায্য প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হওয়ার পরিবর্তে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।

বর্তমান সংকটকে পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সাহায্য বাবদ যে অর্থ বন্ধ করা হয়েছে, তার দশগুণ বেশি আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে খনিজ সম্পদ থেকে।

বৈদেশিক নীতির দুর্বলতাকে আফ্রিকার নিজস্ব সমাধান তৈরির ক্ষেত্রে আরও দৃঢ় হতে উৎসাহিত করতে হবে।

সিদ্ধান্ত আমাদের— হয় আমরা আগামী কয়েক দশক ধরে সাহায্যের জন্য দর কষাকষি করব, অথবা খনিজ সম্পদের কৌশলগত উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করব।

আফ্রিকার উচিত বিশ্বের কাঁচামাল সরবরাহকারী থেকে উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হওয়া।

খনিজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে স্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে, বৈদেশিক সাহায্যকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলাই এখন সময়ের দাবি।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *