আতঙ্কের খবর! বেতন কমে যাওয়ায় আফ্রিকায় সরকারি কর্মীদের নাভিশ্বাস

আফ্রিকার কয়েকটি দেশে সরকারি কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সংকট তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশনএইড-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘আফ্রিকার সরকারি খাতে কাটছাঁটের মানবিক মূল্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে কর্মরত কর্মীদের বেতন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইথিওপিয়া, ঘানা, কেনিয়া, লাইবেরিয়া, মালাউই এবং নাইজেরিয়ার ৯৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী তাদের বেতন দিয়ে খাদ্য ও ভাড়ার মতো প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারছেন না। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী, সরকারগুলো বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কমাচ্ছে। ফলে এই সংকট তৈরি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আফ্রিকার দেশগুলোতে ঋণের বোঝা বাড়ছে এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইএমএফ জনসেবা খাতে অর্থ কাটছাঁট করার পরামর্শ দিচ্ছে। এর ফলস্বরূপ স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে নাইজেরিয়া তাদের জাতীয় রাজস্বের মাত্র ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করেছে, যেখানে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ২০.১ শতাংশ।

স্বাস্থ্যখাতে বাজেট অপ্রতুলতার কারণে চিকিৎসা সেবার মান কমছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রেরও অভাব দেখা যাচ্ছে। কেনিয়ার একজন স্বাস্থ্যকর্মী মারিয়া (ছদ্মনাম) জানিয়েছেন, “গত মাসে আমি দেখেছি, অনেক নারী হাসপাতালে খরচ বহন করতে না পেরে বাড়িতেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে টিকা ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী পাওয়া যায় না বলে মানুষকে এখন বেসরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।”

আফ্রিকা মহাদেশে, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ম্যালেরিয়া একটি প্রধান রোগ। অ্যাকশনএইড জানিয়েছে, এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের দাম এখন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ১০ গুণ বেড়েছে। ইথিওপিয়ার মুয়াকোলা কেবেলার বাসিন্দা মারিয়াম (ছদ্মনাম) জানান, “পাঁচ বছর আগে যেখানে আমরা ৫০ বীরে (প্রায় ৪৫০ টাকা, ১৯ জুন, ২০২৪-এর বিনিময় হার অনুযায়ী) ম্যালেরিয়ার ওষুধ কিনতে পারতাম, এখন সেই ওষুধ বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিনতে গেলে ৫০০ বীরে (প্রায় ৪,৫০০ টাকা)র বেশি খরচ হয়।”

শিক্ষাখাতেও একই অবস্থা। বাজেট কমানোর ফলে শিক্ষার মান কমছে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অভাব দেখা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে শ্রেণীকক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লেগেই আছে। মালাউইয়ের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মালুয়া জানান, “আমি এখন মনে করি, শিক্ষকতা সবচেয়ে অবমূল্যায়িত পেশা। আমার ক্লাসে ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী এবং পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ নেই। ফলে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া প্রায় অসম্ভব।”

লাইবেরিয়ার শিক্ষক কাসর জানিয়েছেন, “আমি প্রায়ই আমার পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাই।” প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত ছয়টি দেশের মধ্যে চারটি তাদের জাতীয় বাজেটের এক-পঞ্চমাংশের কম অর্থ শিক্ষাখাতে ব্যয় করছে।

অ্যাকশনএইড বলছে, আইএমএফ-এর সমর্থনপুষ্ট নীতির কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষকদের কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় সেবার মান সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনাল-এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রধান রোজ সালব্রিংক বলেন, “ঋণ সংকট এবং কঠোরতা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে উন্নয়নশীল ও নিম্ন-আয়ের দেশগুলো আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি একটি অন্যায্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফল, যা আইএমএফ-এর মতো পুরনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিকে আছে। এর অবসান হওয়া উচিত।”

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *