আফ্রিকার জঙ্গলে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য: সাফল্যের গল্পে কতখানি মালিকানার প্রশ্ন?

আফ্রিকার সাফারি শিল্পে কৃষ্ণাঙ্গদের মালিকানা কেন এত কম?

আফ্রিকার সাফারি শিল্প প্রতি বছর ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করলেও, আফ্রিকা ভ্রমণ ও পর্যটন সংস্থার (Africa Travel and Tourism Association) অধীনে থাকা সাফারি ব্যবসাগুলোর মাত্র ১৫ শতাংশের মালিক কৃষ্ণাঙ্গরা। এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা যাক।

জিম্বাবুয়ের ভিম্বাই মাসিয়িওয়া যখন ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের জাতীয় উদ্যানে একটি পারিবারিক সফরে গিয়েছিলেন, তখন এক গাইড এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন যা তাকে বেশ হতাশ করেছিল। গাইড বলেছিলেন, “চিন্তা করবেন না, আমরা যখন লজে পৌঁছাব, তখন দৃশ্যটা আরও সুন্দর হবে।”

স্থানীয় সম্প্রদায়ের দারিদ্র্যকে এড়িয়ে যাওয়ার এই মন্তব্যের মাধ্যমে মাসিয়িওয়া বেশ অস্বস্তি অনুভব করেন। কেন স্থানীয় মানুষের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হবে?

৩০ বছর বয়সী মাসিয়িওয়া এই ধারণা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজের সাফারি কোম্পানি, বাতোকো আফ্রিকা (Batoka Africa) খোলেন। তিনি প্রথম নারী সাফারি লজ মালিক, যিনি জিম্বাবুয়েকে ভালোবাসেন এবং তার কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য মানুষের উপর গুরুত্ব দেওয়া।

মাসিয়িওয়া বলেন, “আপনি যখন মানুষের প্রতি মনোযোগ দেন এবং তারা বুঝতে পারে যে তারা গুরুত্বপূর্ণ, তখন তারা তাদের চারপাশের বন্যজীবন এবং সেটি রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে।” তিনি তাদের প্রথম বিলাসবহুল লজ, জাম্বেজি স্যান্ডস রিভার লজ (Zambezi Sands River Lodge), যা ২০২৩ সালের জুনে খোলা হয়, সেটির উদাহরণ দেন।

কিন্তু মাসিয়িওয়া এখনো ব্যতিক্রম। সাফারি শিল্পে কৃষ্ণাঙ্গদের মালিকানার এই স্বল্পতার মূল কারণ অনুসন্ধান করলে ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং পদ্ধতিগত অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে আসে।

আফ্রিকা পর্যটন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নালিদি খাবো (Naledi Khabo) বলেন, “ঐতিহাসিক ভূমি বেদখলের ফলে সীমিত ভূমি মালিকানার সুযোগ তৈরি হয়েছে।”

উনিশ শতকের শেষের দিকে, ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় অভিযাত্রী এবং আমেরিকানরা মানচিত্র তৈরি ও শিকারের জন্য পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণ করত। আজও অনেক সাফারি লজের মালিক মূলত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, যাদের প্রধান গ্রাহক ধনী আন্তর্জাতিক পর্যটকরা।

সাফারি লজ স্থাপন এবং পরিচালনার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো খাতে প্রচুর পুঁজির প্রয়োজন, যা অনেক সময় সহজলভ্য হয় না। খাবো যোগ করেন, “আফ্রিকার মালিকানাধীন ক্যাম্পগুলো সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব এবং অতিথিদের অভিজ্ঞতায় আরও বেশি একাত্মতা আনবে, যা আরও অর্থপূর্ণ অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত থাকার মাধ্যমে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা আরও গভীর হবে, কারণ স্থানীয় সম্প্রদায়ের এতে প্রত্যক্ষ আগ্রহ থাকবে।”

জিম্বাবুয়ের উদ্যোক্তা এবং প্রাক্তন গাইড বেক্স এনডলোভু (Beks Ndlovu), আফ্রিকার সুন্দর দৃশ্যগুলোর বাইরে এখানকার দারিদ্র্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আফ্রিকান বুশ ক্যাম্পস (African Bush Camps – ABC) খোলেন। এই পুরস্কার বিজয়ী সাফারি কোম্পানিটি সংরক্ষিত এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত তাদের উচ্চ-শ্রেণীর লজ ও ক্যাম্পের জন্য পরিচিত, যা সংরক্ষণ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের উপর জোর দেয়।

এনডলোভু বলেন, “সুন্দর জাতীয় উদ্যানগুলোর বাইরে দারিদ্র্যের চরম রূপ, বন্যপ্রাণীর উপর বছরের পর বছর ধরে চলা নিষ্ঠুরতা এবং আবাসস্থলের ক্ষয় আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।”

২০০৬ সালে, এনডলোভু জিম্বাবুয়ের হাঙ্গে জাতীয় উদ্যানে (Hwange National Park) তাঁর প্রথম ক্যাম্প – সোমালিসা ক্যাম্প (Somalisa Camp) খোলেন, যেখানে মাত্র ১৬ জন কর্মী ছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল এই শিল্পের দূত তৈরি করা এবং অন্যদের অনুপ্রাণিত করা।

বর্তমানে, এবিসি জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা এবং জাম্বিয়াজুড়ে ১৭টি বিলাসবহুল বুশ ক্যাম্প পরিচালনা করে, যেখানে ৭০০ জন স্থানীয় বাসিন্দা কাজ করেন।

তবে এই শিল্পে প্রবেশ করা সহজ ছিল না। জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক পতন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুতে ক্লায়েন্টদের ভয় দেখিয়েছিল।

এনডলোভু আরও একটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন, সেটি হল বিশ্বাস তৈরি করা। শুরুতে, সম্ভাব্য ক্লায়েন্টরা দ্বিধা বোধ করতেন এবং জানতে চাইতেন, একজন আফ্রিকান-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করা কতটা নিরাপদ।

তবে, একজন খ্যাতিমান গাইড হিসেবে তাঁর খ্যাতি এক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল।

মাসিয়িওয়াও একই অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, সম্প্রতি এক এজেন্ট তাকে বলেছিলেন যে, একজন অতিথি তাদের লজটি বেছে নেননি, কারণ তিনি সেখানকার পরিষেবা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না।

মাসিয়িওয়া বলেন, “এই ধারণা পরিবর্তন করতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লাগবে – এটি মানসিকতা পরিবর্তন এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ দূর করার বিষয়।”

অন্যদিকে, ১৯৯৭ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার তিন বছর পর প্রবীণ মোমান (Praveen Moman) উগান্ডা, রুয়ান্ডা এবং কঙ্গোর সীমান্তবর্তী মাউন্ট গাহিঙ্গা লজ (Mount Gahinga Lodge) খোলার সময় ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।

মোমান নিজে বাস্তুচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, কারণ ১৯৭০-এর দশকে তাঁর পরিবারকে উগান্ডা থেকে পালাতে হয়েছিল। রুয়ান্ডার জাতীয় উদ্যানগুলো পুনরায় চালু হওয়ার পর তিনি ভলকানোস সাফারিস (Volcanoes Safaris) প্রতিষ্ঠা করেন।

তবে দক্ষ কর্মী খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল, কারণ “হয় তারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, না হয় মারা গিয়েছিল, অথবা তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।” মোমান বলেন।

এই কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও, তিনি বহিরাগতদের উপর নির্ভর না করার একটি দর্শন তৈরি করেন।

তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদের মানুষের দক্ষতা ও সক্ষমতা তৈরি করতে হয়েছিল। আমরা আমাদের কর্মীদের ক্ষমতায়ন, প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি এবং তাদের বিশ্বাস করতে শেখাই যে তারা ব্যবস্থাপক হতে পারে, নেতৃত্ব দলের অংশ হতে পারে এবং শিখতে ও উন্নতি করতে পারে।”

বর্তমানে, ভলকানোস সাফারিস গ্রেট এপের (great ape) ইকোট্যুরিজম ও সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা উগান্ডা ও রুয়ান্ডাজুড়ে তিনটি গরিলা লজ এবং দুটি শিম্পাঞ্জি লজ পরিচালনা করে, যেখানে আশেপাশের এলাকার ৩০০ জন কর্মী কাজ করেন।

বন্যপ্রাণী রক্ষা অনেক শীর্ষস্থানীয় সাফারি কোম্পানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ বন্যপ্রাণী না থাকলে পর্যটনও দুর্বল হয়ে পড়ে।

অনেক সাফারি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য চাকরি, প্রশিক্ষণ এবং অতিথিদের অনুদানের মাধ্যমে সহায়তা করে। খাবো বলেন, আফ্রিকান মালিকানাধীন লজগুলো আরও এক ধাপ এগিয়ে, স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর তাদের প্রভাব আরও গভীর করে তোলে।

এরকম একটি উদাহরণ হল বাতওয়া (Batwa) সম্প্রদায়ের মানুষজন, যারা মধ্য আফ্রিকার আদি বাসিন্দা।

১৯৯০-এর দশকে, সরকার যখন গরিলা রক্ষার জন্য জাতীয় উদ্যান খোলা শুরু করে, তখন তাদের রুয়ান্ডা, উগান্ডা ও কঙ্গোর আদি বনভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। তাদের কোনো কৃষি ঐতিহ্য, জমির অধিকার বা বিকল্প জীবিকা ছিল না, যার ফলে বাতওয়ারা সাংস্কৃতিক পরিচয় হারায় এবং তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়।

মোমান যখন তাঁর প্রথম লজ তৈরি করছিলেন, তখন তিনি প্রত্যক্ষ করেন বাতওয়ারা কীভাবে কাছাকাছি বস্তিতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছিল।

প্রথমে, তিনি অতিথিদের তাদের দুর্দশা দেখানোর জন্য নিয়ে যেতেন – কিন্তু তিনি দ্রুত বুঝতে পারেন যে পর্যটকদের আকর্ষণ হিসেবে মানুষের দুঃখ ব্যবহার করতে চান না।

এর পরিবর্তে, তিনি মাউন্ট গাহিঙ্গা লজের কাছে গাহিঙ্গা বাতওয়া গ্রাম (Gahinga Batwa Village) তৈরি করেন, যেখানে স্থায়ী বাসস্থান, একটি কমিউনিটি সেন্টার এবং ১০০ জনের বেশি মানুষের জন্য কৃষি জমির ব্যবস্থা করা হয়।

মোমান বলেন, লজগুলো “ধনী ব্যক্তিদের জন্য বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হওয়া উচিত নয়, বরং বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে।”

আবাসনের বাইরে, ভলকানোস সাফারিস বাতওয়াদের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায়ও সাহায্য করে।

মোমান বলেন, “আমাদের বাতওয়া গ্রামের কিছু শিশু ক্লাসে ভালো ফল করছে।” এই কোম্পানি কিয়াম্বুরা বাফার জোনও তৈরি করেছে, যা শিম্পাঞ্জিদের শিকার এবং বন্যপ্রাণীর খামারে প্রবেশ করা থেকে রক্ষা করে।

অন্যান্য আফ্রিকান মালিকানাধীন সাফারি কোম্পানিও বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তন আনছে।

বাতোকো আফ্রিকা শুরু থেকেই স্থানীয় অর্থনীতিকে সমর্থন করার জন্য কমিউনিটি প্রকল্প যুক্ত করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন কর্মী একটি মহিলা সেলাই দলের সঙ্গে যুক্ত, যারা লজের জন্য প্রয়োজনীয় কিট, ব্যাগ এবং ন্যাপকিন তৈরি করে, যা অতিথিরা কিনতে পারেন।

এবিসি বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে সহায়তা করে, যাতে মানুষ গাছ পোড়ানো বা কাঠকয়লা বিক্রি না করে আয় করতে পারে।

কোম্পানিটি নারী গাইডদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং উৎসাহিত করে, যা ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত এই শিল্পে আরও বেশি নারীকে অন্তর্ভুক্ত করে।

আফ্রিকান বুশ ক্যাম্পস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে, এনডলোভু সংরক্ষণকে সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত করেন – তবে তাঁর লক্ষ্য শুধু টিকে থাকা নয়, পুনরুজ্জীবনও।

এনডলোভু বলেন, “এটি একটি সামগ্রিক চিত্র, যেখানে আমরা আমাদের গল্প বলি এবং আমাদের জীবন যাপন করি। এমন একজন মানুষ এই গল্প বলেন, যিনি তাদের মতো কথা বলেন, তাদের মতো দেখতে এবং তাদের মতোই প্রেক্ষাপট থেকে এসেছেন, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে এবং বিশ্বাস করতে সাহায্য করে যে এটি এমন একটি শিল্প এবং কর্মজীবন, যা আমরা তৈরি করতে পারি এবং আমরা যেখানে কাজ করি, সেখানে একটি অর্থবহ এবং প্রভাবশালী এজেন্ডা তৈরি করতে পারি।”

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *