নতুন দিগন্তের সূচনা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়ায় কল সেন্টার শিল্পে পরিবর্তন।
বর্তমানে, সারা বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং গ্রাহক সেবার ধরন দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)।
কল সেন্টার শিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে গ্রাহক পরিষেবা প্রদানের পদ্ধতিতে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে একদিকে যেমন গ্রাহকদের জন্য পরিষেবা আরও সহজলভ্য হচ্ছে, তেমনি কর্মীদের কাজের ধরনেও আসছে ভিন্নতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে বিপিও (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, সেখানে এই পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
কল সেন্টারগুলোতে এআই ব্যবহারের প্রধান দিকগুলো হলো গ্রাহকদের সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর সমাধান দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, একটি এআই সিস্টেম গ্রাহকের কণ্ঠস্বর বিশ্লেষণ করে তাঁর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী উপযুক্ত সমাধান দিতে পারে। এর ফলে, গ্রাহকরা দ্রুত তাদের সমস্যার সমাধান পান এবং কর্মীদের সময় বাঁচে।
অনেক সময় দেখা যায়, গ্রাহকদের দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে অপেক্ষা করতে হয়, যা তাদের বিরক্তির কারণ হয়। এআই ব্যবহারের ফলে এই সমস্যা অনেকাংশে কমে আসে।
তবে, এআই ব্যবহারের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অনেক সময় জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে এআই-এর পক্ষে মানুষের মতো দক্ষ হওয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয়।
সুইডেনের একটি ‘Buy Now, Pay Later’ কোম্পানি ক্লার্না (Klarna), তাদের গ্রাহক পরিষেবা বিভাগে এআই ব্যবহারের চেষ্টা করে। তারা তাদের ৭০০ জন কর্মীর পরিবর্তে চ্যাটবট ও এআই ব্যবহার করে, কিন্তু গ্রাহক সন্তুষ্টির হারে কিছুটা অবনতি হয়। পরে তারা বুঝতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে মানুষের দক্ষতা অপরিহার্য।
বিশেষ করে, পরিচয় চুরি বা জটিল বিষয়ে মানুষের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এআই প্রযুক্তি কল সেন্টার কর্মীদের কাজকে আরও সহজ করে তুলেছে। বর্তমানে, কর্মীদের হাতে গ্রাহকদের বিস্তারিত তথ্য থাকে, যা তাদের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।
গ্রিসের এথেন্সের বাসিন্দা আরমেন কিরাকোসিয়ান, যিনি একটি কল সেন্টারে কাজ করেন, তিনি জানান, এআই ব্যবহারের ফলে তাঁর কাজের চাপ কমেছে এবং তিনি গ্রাহকদের আরও ভালোভাবে পরিষেবা দিতে পারছেন। তিনি বলেন, “এআই আমাদের মধ্যে থেকে যন্ত্রমানবকে দূর করেছে।
এআই-এর কারণে কল সেন্টার শিল্পের কর্মীদের কাজের ধরনও পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে, কর্মীদের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে, যেখানে এআই-এর সাহায্য নেওয়া সম্ভব নয়। এর ফলে, কর্মীদের নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কর্মীদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করছে।
এই পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বয়ংক্রিয় ভয়েস রেসপন্স সিস্টেম (IVR)-এর উন্নতি। আগে, গ্রাহকদের বিভিন্ন মেনুর মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে বের করতে হতো, যা সময়সাপেক্ষ ছিল।
বর্তমানে, এআই-এর মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের সমস্যার কথা সরাসরি বলতে পারেন এবং দ্রুত সমাধান পেতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক অফ আমেরিকার “এরিয়া” নামক চ্যাটবট গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন পরিষেবা সরবরাহ করে।
এরিয়া গ্রাহকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, তাদের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে এবং উপযুক্ত বিভাগে কল ট্রান্সফার করতে পারে। এর ফলে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা আরও উন্নত হচ্ছে।
বাংলাদেশেও বিপিও শিল্পের প্রসার ঘটছে, এবং এখানেও এআই-এর ব্যবহার বাড়ছে। বিভিন্ন কল সেন্টার তাদের গ্রাহক পরিষেবা উন্নত করতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
এর ফলে, একদিকে যেমন ব্যবসার খরচ কমছে, তেমনি গ্রাহক পরিষেবাও উন্নত হচ্ছে। তবে, কর্মীদের নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।
ভবিষ্যতে, কল সেন্টার শিল্পে এআই-এর ব্যবহার আরও বাড়বে। গ্রাহক পরিষেবা আরও ব্যক্তিগতকৃত হবে এবং কর্মীদের কাজের ধরন আরও উন্নত হবে।
তবে, মানুষের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার গুরুত্বও অপরিসীম। এই শিল্পে টিকে থাকতে হলে, কর্মীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং গ্রাহক পরিষেবার ওপর বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
একই সাথে, কোম্পানিগুলোকে কর্মীদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
এআই প্রযুক্তি কল সেন্টার শিল্পে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এটি একদিকে যেমন গ্রাহক পরিষেবা উন্নত করছে, তেমনি কর্মীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে।
বাংলাদেশের বিপিও শিল্পের জন্য, এই পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে, বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস