যুক্তরাষ্ট্রের আদালতগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার বাড়ছে, যা বিচার ব্যবস্থায় নতুন কিছু জটিলতা সৃষ্টি করছে। ভুক্তভোগীর বক্তব্য উপস্থাপন থেকে শুরু করে মামলার শুনানিতে অভিযুক্তের অবতার তৈরি করা—এসব ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে এখন তীব্র বিতর্ক চলছে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা যেমন বাড়ছে, তেমনি ন্যায়বিচারের ধারণাটিও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। সেখানে, ক্রিস্টোফার পেলকি নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা ঘোষণার সময় এক অভিনব দৃশ্য দেখা যায়।
নিহত ক্রিস্টোফারের একটি এআই-নির্মিত ভিডিও তৈরি করা হয়, যেখানে তাকে তার হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে দেখা যায়। বিচারক এই ভিডিওর প্রশংসা করেন এবং অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন।
এই ঘটনার পর, অভিযুক্তের আইনজীবী আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার মতে, বিচারক এই এআই-নির্মিত ভিডিওর ওপর নির্ভর করে রায় দিয়েছেন, যা সঠিক হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আদালতে এখন এআইয়ের ব্যবহার বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধের দৃশ্য তৈরি করা এবং মামলার শুনানিতে অভিযুক্তের হয়ে এআই অবতারের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপন করা।
ফ্লোরিডায়, একজন বিচারক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট পরে একটি মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে অভিযুক্ত নিজেকে আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক উঁচিয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তবে, বিচারক তার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
এছাড়া, নিউইয়র্কে এক ব্যক্তি, যিনি নিজে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেননি, তিনি একটি এআই-নির্মিত অবতার ব্যবহার করে মামলার শুনানিতে অংশ নেন। তবে, আদালত দ্রুতই বুঝতে পারেন যে, ভিডিওতে কথা বলা ব্যক্তিটি আসল নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের কার্যক্রমে এআইয়ের ব্যবহার কিছু গুরুতর আইনি এবং নৈতিক প্রশ্ন তৈরি করে। বিশেষ করে, যদি এই প্রযুক্তি বিচারক বা জুরিদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়, তবে এর ফল মারাত্মক হতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলে বিজনেস স্কুলের এআই বিশেষজ্ঞ ডেভিড ইভান হ্যারিস বলেন, “এআই খুব সহজেই মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই, এই প্রযুক্তি এবং এর মাধ্যমে তথ্য ম্যানিপুলেশনের বিষয়টি নিয়ে এখন গবেষণা চলছে।”
ব্রুকলিন ল স্কুলের অধ্যাপক এবং প্রাক্তন সরকারি আইনজীবী সিনথিয়া গডসো মনে করেন, প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, আদালতের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। যেমন—এআই ছবিগুলো সাক্ষীর বর্ণনার সঙ্গে মিলছে কিনা, অথবা ভিডিওতে অভিযুক্তের উচ্চতা, ওজন বা ত্বকের রং বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে কিনা, সে সব বিষয় এখন খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
তিনি একে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে উল্লেখ করেন, কারণ এর মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অ্যারিজোনার ঘটনায়, নিহত ক্রিস্টোফার পেলকির বোন স্টেসি ওয়েলস জানান, তারা এই এআই ভিডিও তৈরির আগে এর নৈতিক দিকগুলো বিবেচনা করেছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ক্রিস্টোফারকে মানবিক রূপে উপস্থাপন করা।
আদালতে ভুক্তভোগীর বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ফরম্যাট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। মারিকোপা কাউন্টি সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক টড ল্যাং, এআই ভিডিওটি দেখে এর প্রশংসা করেন এবং বলেন, “ভিডিওটি পরিবারের গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।”
এআই প্রযুক্তির এই ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বিচার ব্যবস্থায় একদিকে যেমন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, তেমনি এর অপব্যবহারের ঝুঁকিও বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও প্রযুক্তিনির্ভর বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হতে পারে, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং নৈতিকতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস