স্মৃতিকে নতুন রূপে ফেরানো: এআই-এর সাহায্যে কি বয়স্ক এবং শরণার্থীদের অতীতে ফেরা সম্ভব?
যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট অথবা নিপীড়ন—মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো কি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব? আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এমনই এক অভিনব প্রকল্পের কথা জানা যাচ্ছে, যা হারানো স্মৃতিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করতে পারে।
বার্সেলোনার ‘ডমেস্টিক ডেটা স্ট্রিমার্স’ (ডিডিএস) নামের একটি ডিজাইন স্টুডিও ‘সিন্থেটিক মেমোরিজ’ নামে এই প্রকল্পটি তৈরি করেছে।
২০১৫ সালে, যখন ইউরোপে শরণার্থী সংকট চরম আকার ধারণ করে, সেই সময় গ্রিসে আসা শরণার্থীদের সহায়তা করার অভিজ্ঞতা থেকে প্রকল্পটির ধারণা আসে। স্প্যানিশ স্বেচ্ছাসেবক পাও আলেইকুম গার্সিয়া গ্রিসের এথেন্সে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য পরিত্যক্ত স্কুল ও লাইব্রেরিতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তিনি শরণার্থীদের জন্য কমিউনিটি কিচেন, ভাষা শিক্ষা এবং শিল্পকর্মের মতো কার্যক্রমও পরিচালনা করতেন। গার্সিয়া জানান, সেই সময়টা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং অনেক স্মৃতিই যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তবে তার মনে গেঁথে ছিল এক বৃদ্ধা সিরিয়ান নারীর কথা।
ঐ বৃদ্ধা বলেছিলেন, “শরণার্থী হতে আমার ভয় নেই। আমি জীবন যাপন করেছি। আমি যা দেখেছি, তাতে আমি খুশি। আমার ভয় হয় আমার নাতি-নাতনিরা সারাজীবন শরণার্থী হয়ে থাকবে।”
পরিবারের ছবি অ্যালবাম হারিয়ে যাওয়ায় তাদের সিরিয়ার জীবনের স্মৃতিগুলো শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মনে সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সেই স্মৃতিগুলো আর পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। গার্সিয়ার মনে হয়, ছবি হলো একটি প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের সংযোগ স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
২০১৯ সাল নাগাদ যখন জেনারেটিভ এআই-এর উন্মোচন হয়, তখন গার্সিয়া সেই সিরীয় বৃদ্ধার কথা পুনরায় স্মরণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন, এই প্রযুক্তি স্মৃতিগুলো পুনরুদ্ধার করতে কাজে আসতে পারে।
এরপর ২০২২ সালে, গার্সিয়া এবং তার দল ‘সিন্থেটিক মেমোরিজ’ প্রকল্পটি শুরু করেন। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ছবি বা অন্যান্য তথ্যের অভাবে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে এআই ব্যবহার করে চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা।
প্রকল্পের শুরুতে, অংশগ্রহণকারীদের তাদের সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করতে বলা হয়। স্মৃতিগুলো বলার পরে, ইন্টারভিউয়ার সেই স্মৃতিকে একটি ছবিতে রূপ দেওয়ার জন্য এআইকে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে বলেন।
‘ডাল-ই ২’ (DALL-E 2) এবং ‘ফ্লাক্স’-এর (Flux) মতো ওপেন সোর্স ইমেজ-জেনারেটিং এআই সিস্টেম ব্যবহার করে এই ছবিগুলো তৈরি করা হয়। ছবিতে পোশাক, চুলের ধরন এবং আসবাবপত্রের মতো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যতটা সম্ভব সঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়।
তবে, ছবির চরিত্রগুলোর মুখ সাধারণত অস্পষ্ট রাখা হয়। গার্সিয়ার মতে, এর কারণ হলো, তারা চান এই ছবিগুলো যেন বাস্তব না হয়ে বরং স্মৃতির অনুভূতি প্রকাশ করে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি ছবিগুলো স্বপ্নময় এবং অস্পষ্ট হতে পারে। গার্সিয়ার মতে, স্মৃতি খুব দুর্বল এবং এতে অনেক অসম্পূর্ণতা থাকে। তাই, তারা এমন একটি মডেল তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা দুর্বলতা এবং অসম্পূর্ণতা দিয়ে ভরা থাকবে, যা আমাদের স্মৃতির ধারণাকে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলবে।
ডিডিএস প্রথমে তাদের পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এটি ছিল অত্যন্ত আবেগপূর্ণ অভিজ্ঞতা। এরপর তারা স্মৃতিভ্রংশ রোগীদের স্মৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করে।
তারা ব্রাজিলের বলিভীয় এবং কোরীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করে তাদের অভিবাসনের গল্পগুলো তুলে ধরে। বার্সেলোনার সিটি কাউন্সিলের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে স্থানীয় স্মৃতিগুলোও তারা সংরক্ষণ করেছে।
বার্সেলোনার ডিজাইন মিউজিয়ামে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি ৩০০টির বেশি স্মৃতি উপস্থাপন করা হয়েছিল। অনেকে তাদের জীবনের দুঃখজনক ঘটনাগুলো স্মরণ করতে চেয়েছিলেন, আবার কেউ শৈশবের স্মৃতিগুলো পুনরায় অনুভব করতে চেয়েছিলেন।
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়কার এক ঘটনাও এই প্রকল্পের মাধ্যমে পুনরায় চিত্রিত করা হয়েছে। কারমেন নামের নব্বইোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা, যিনি ছোটবেলায় তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য একটি কারাকক্ষের বারান্দায় গিয়েছিলেন। তার বাবা ছিলেন রিপাবলিকান ফ্রন্টের ডাক্তার এবং কারাগারে বন্দী ছিলেন।
এই ছবিটি তৈরি করতে পেরে কারমেনের পরিবারের সদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফ্রাঙ্কোর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের স্মৃতিগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন জোসে কার্লেস ভ্যালেইও ক্যালডেরন।
তিনি জানান, ১৯৭০ সালে শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরির অভিযোগে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কারাগারে নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালে ফ্রান্সে পালিয়ে যান এবং পরে ইতালিতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন।
এই প্রকল্পের একটি ছবিতে দেখা যায়, জোসে কার্লেস ভ্যালেইও ক্যালডেরন এবং তার সঙ্গীরা ভ্যালিভিদ্রের বনের মধ্যে একত্রিত হয়ে গোপনে আলোচনা করছেন। এই ধরনের সভাগুলোর কোনো রেকর্ড ছিল না।
এআই-এর মাধ্যমে তৈরি করা ছবিতে সেই সময়ের একটি ভীতিকর পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভ্যালেইও বলেন, এই ছবিটি তাকে সেই সময়ের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
তবে, এই প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ‘অ্যালান টুরিং ইনস্টিটিউট’-এর ডেটা সায়েন্স এবং এআই বিষয়ক পরিচালক ডেভিড লেসলি সতর্ক করে বলেছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট ডেটা ব্যবহার করা হলে তা ভুল ইতিহাস তৈরি করতে পারে।
গার্সিয়ার মতে, সিন্থেটিক মেমোরিজ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ঐতিহাসিক ঘটনার পুনর্গঠন করা নয়, বরং ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলোকে তুলে ধরা। তিনি মনে করেন, এই প্রকল্পটি শুধু স্মৃতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সাহায্য করবে না, বরং বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং প্রজন্মের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করবে।
ভবিষ্যতে, ডিডিএস প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ‘জরুরি স্মৃতি ক্লিনিক’ স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। তারা নার্সিং হোমগুলোতে বিনামূল্যে এই প্রযুক্তি সরবরাহ করারও আশা রাখে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা