মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় প্রায়শই ত্রুটি দেখা যাচ্ছে, যা যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি, নিউইয়র্কের নিউয়ার্ক বিমানবন্দরে যোগাযোগে বিভ্রাটের ঘটনার পর, সারা দেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার এবং পাইলটরা বিভিন্ন সরঞ্জাম বিভ্রাটের খবর দিয়েছেন।
এর ফলে মাঝ আকাশে সংঘর্ষ এবং অন্যান্য মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।
২০২৩ সালে, টাম্পা শহরে কর্মরত একজন অভিজ্ঞ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জানিয়েছেন, দুটি বিমানের মধ্যে, একটি বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমানসহ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
বিমান দুটি একটি “সংঘর্ষের পথে” চলে এসেছিল, তবে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়া যায়।
আরেকটি ঘটনায়, ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একজন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জানান, বিমানের দরজা খুলে যাওয়ার পর জরুরি অবতরণ করতে চাওয়া একটি বিমানের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি। এই ধরনের ঘটনাগুলো “আসলে কারো জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে,” এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে একটি প্রতিবেদনে।
সিএনএন-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সাল থেকে নাসা’র বিমান নিরাপত্তা রিপোর্টিং সিস্টেমে রাডার এবং রেডিওর সমস্যা নিয়ে ৪০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এই তথ্য পুরনো প্রযুক্তির একটি উদ্বেজনক চিত্র তুলে ধরেছে, যা শুধু নিউয়ার্ক বিমানবন্দরের সমস্যা নয়, বরং একটি বিস্তৃত সমস্যা।
ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ)-এর নিজস্ব সতর্কবার্তাতেও এই ব্যাপক বিভ্রাটের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। সিএনএন-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত বছর প্রায় প্রতিদিনই এফএএ কমপক্ষে একটি এয়ার ট্রাফিক সতর্কতা জারি করেছে, যেখানে রাডার, রেডিও বা ফ্রিকোয়েন্সি পরিষেবা বন্ধ থাকা অথবা “সমস্যা” হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করা ডেভ রাইলি বলেন, “বিমানে চড়ার সময় সাধারণ মানুষের মনে এমন চিন্তা আসার কথা নয় যে, সেখানকার সরঞ্জাম কাজ করবে কিনা।” তিনি আরও বলেন, সিএনএন কর্তৃক চিহ্নিত প্রতিবেদনগুলো অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ।
“এখানে অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় রয়েছে, যা খতিয়ে দেখা দরকার।”
এফএএ-এর বেশিরভাগ সতর্কবার্তায় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি, তাই সমস্যাগুলো কতটা গুরুতর ছিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে কিছু ঘটনার কারণে বিভিন্ন বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড স্টপ বা বিলম্ব হয়েছে।
অনেক সতর্কবার্তায় স্পষ্টভাবে “সরঞ্জাম/বিভ্রাট”-এর কারণে সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এফএএ নির্দিষ্ট নিরাপত্তা প্রতিবেদনগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি এবং সিএনএন কর্তৃক চিহ্নিত ঘটনাগুলোর তদন্ত করা হয়েছে কিনা বা সেই স্থানগুলোতে উন্নতি করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও কিছু জানায়নি।
তবে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে যে তাদের সিস্টেমে ৭৪,০০০-এর বেশি সরঞ্জাম রয়েছে এবং সমস্ত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সুবিধার জন্য জরুরি পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে অতিরিক্ত ব্যবস্থা, ব্যাকআপ এবং সরঞ্জাম বিভ্রাট, আবহাওয়া বা অপ্রত্যাশিত ঘটনার মোকাবিলার জন্য পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সহকারী অধ্যাপক এবং প্রাক্তন এয়ার ফোর্স এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার মার্গারেট ওয়ালেস বলেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এফএএ চিহ্নিত বিভ্রাট সম্ভবত গুরুতর বিপদ সৃষ্টি করেনি, কারণ ব্যাকআপ ব্যবস্থা ছিল।
তবে তিনি আরও জানান, কয়েক দশক পুরনো এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল প্রযুক্তি, যার মধ্যে বিপর্যয় রোধ করার জন্য ব্যাকআপ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সেগুলোর সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে কোনো স্তরের সরঞ্জাম বিভ্রাট কন্ট্রোলার এবং পাইলটদের বিভ্রান্ত করতে পারে, চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং সম্ভবত তাদের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
উতাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির বিমান প্রযুক্তি বিভাগের প্রাক্তন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার এবং অধ্যাপক অ্যারন হুইটল বলেন, “যখন রেডিও সরঞ্জাম বা যোগাযোগের লাইন দুর্বল হয়, তখন একজন কন্ট্রোলারের কাজের চাপ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়।
বিমানের ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে, কন্ট্রোলারকে রেডিওর সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে হয়, যা একটি বিপজ্জনক বিভ্রান্তি তৈরি করে।
অভিজ্ঞ কন্ট্রোলাররা হয়তো এটি ভালোভাবে সামলাতে পারেন, তবে এটি এখনও একটি বাস্তব নিরাপত্তা ঝুঁকি।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১০,০০০ এর বেশি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার কাজ করেন। তারা বিমানবন্দরের টাওয়ারে এবং আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতে বিমান চলাচলের উপর নজর রাখেন এবং বিমানগুলোর নিরাপদ অবতরণ ও উড্ডয়ন নিশ্চিত করেন।
তাদের প্রধান কাজ হল বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে, নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী রেডিও এবং রাডারের জরুরি ভিত্তিতে আধুনিকীকরণ প্রয়োজন।
নাসার ডেটাবেসে জমা দেওয়া বেনামী নিরাপত্তা প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, অবকাঠামোগত ত্রুটির কারণে কন্ট্রোলার, পাইলট এবং যাত্রীরা মাঝে মাঝে গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছেন।
কিছু ক্ষেত্রে, কন্ট্রোলাররা জানিয়েছেন যে ব্যাকআপ সিস্টেমগুলোও সঠিকভাবে কাজ করছিল না।
এফএএ জানিয়েছে, তারা তাদের সিস্টেমের আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা করছে, যার মধ্যে হাজার হাজার রেডিও এবং শত শত রাডার পরিবর্তন করা হবে এবং আরও ব্যাপক কভারেজের জন্য নতুন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হবে।
তবে এতে সময় এবং প্রচুর সম্পদের প্রয়োজন হবে এবং কংগ্রেসের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলারের তহবিল পাওয়া না গেলে এটি সম্ভব হবে না।
সাবেক এফএএ কর্মচারী রাইলি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই বিভ্রাটের কারণে বিমান শিল্পে কী ঘটতে পারে।
তিনি মনে করেন, জরুরি অবস্থার সময়, যখন সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে যায়, তখন চাপ বাড়ে এবং হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন