আমেরিকার আকাশে এক বিস্ময়: কিভাবে বদলে দিলেন অ্যামেলিয়া?

আকাশের রানী: অ্যামেলিয়া এয়ারহার্ট, যিনি নারী মুক্তি ও দুঃসাহসিকতার প্রতীক।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন আকাশ পথে মানুষের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে, সেই সময়ে একজন নারী, যিনি পুরুষের চোখেও ঈর্ষণীয়, তিনি হলেন অ্যামেলিয়া এয়ারহার্ট।

১৯৩৭ সালের জুন মাসে, বিশ্বকে জয় করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি তাঁর ‘লকহিড ইলেক্ট্রা’ বিমানে চেপে বসেন। উদ্দেশ্য ছিল, বিমানের একাকী চালক হিসেবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা, যা আগে কোনো নারীর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

কিন্তু এই দুঃসাহসিক যাত্রা এক রহস্যের জন্ম দেয়। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিমানটি হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়।

এরপর কেটে গেছে বহু বছর, কিন্তু তাঁর ভাগ্যের কোনো কিনারা হয়নি। অ্যামেলিয়া এয়ারহার্টের এই অজানাই তাঁর জীবনকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

১৮৯৭ সালে কানসাসের অ্যাচিসন শহরে জন্ম নেওয়া অ্যামেলিয়া ছিলেন দুই বোনের মধ্যে বড়। তাঁর বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী এবং মা ছিলেন স্থানীয় সমাজের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য।

ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে খেলাধুলায় মেতে উঠতেন। স্কুলে মেয়েদের স্কার্টের বদলে ব্লাউজ পরে খেলাধুলা করার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন।

সেই সময় নারীদের জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশ সীমাবদ্ধ, যেখানে তাঁদের প্রধান ভূমিকা ছিল সংসার ও সন্তান পালন করা। কিন্তু অ্যামেলিয়া স্বপ্ন দেখতেন নিজের ক্যারিয়ার গড়ার, চেয়েছিলেন স্বাধীনতা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কানাডার একটি সামরিক হাসপাতালে নার্সিংয়ের কাজ করেন। পরে ১৯২৫ সালে তিনি সমাজকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন।

তবে, তাঁর আসল ভালোবাসা ছিল আকাশ, বিমান ও উড়োজাহাজ। ১৯০৩ সালে রাইট ভাইদের উড়োজাহাজ আবিষ্কারের পর থেকেই তিনি আকাশ জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

১৯২০ সালে এক বিমান প্রদর্শনীতে বাবার সঙ্গে যোগ দেন এবং সেখানে একটি ফ্লাইটে অংশ নেন। এরপর থেকেই তিনি উড়োজাহাজ চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন এবং ১৯২৩ সালে তিনি ফেডারেশন অ্যারোনেটিক ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে লাইসেন্স লাভ করেন।

এই সংস্থাটি খেলাধুলা বিষয়ক বিমান চালনার অনুমোদন দেয়।

আর্থিক সমস্যার কারণে শুরুতে বিমান কেনার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তবে, নিজের ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমে তিনি ১৯২৮ সালে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়া প্রথম নারী হওয়ার সুযোগ পান।

যদিও তিনি সরাসরি বিমান চালাননি, তবুও এই ঘটনা তাঁকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করে তোলে। এরপর তিনি নিজের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক রেকর্ড গড়তে শুরু করেন।

১৯৩২ সালে তিনি একাই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেন এবং ১৯৩৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে একাকী উড্ডয়ন করেন।

তাঁর খ্যাতি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। চার্লস লিন্ডবার্গ নামক আরেকজন বিখ্যাত বৈমানিকের সঙ্গে তাঁর চেহারার মিল থাকার কারণে তাঁকে ‘লেডি লিন্ডবার্গ’ নামে ডাকা হতো। এরপরই আসে সেই বহু আকাঙ্খিত বিশ্ব ভ্রমণের পরিকল্পনা।

তবে, এই যাত্রা যেন এক বেদনাদায়ক পরিণতি ডেকে আনে। ১৯৩৭ সালের ১লা জুন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি ও তাঁর সঙ্গী ফ্রেড নুনান প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়ে যান।

তাঁদের বিমান, তাঁদের কোনো চিহ্ন আজও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

অ্যামেলিয়া এয়ারহার্টের অন্তর্ধান আজও একটি রহস্য। তাঁর বিমান কিu কোনো দ্বীপে বিধ্বস্ত হয়েছিল?

নাকি, জাপানি সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়ে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নিহত হয়েছিলেন? এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহু আলোচনা হয়েছে, গবেষণা হয়েছে।

কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে, তাঁর এই রহস্যময় পরিণতি সত্ত্বেও, একজন নারী হিসেবে বিমান চালনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শুধু আকাশ জয় করেননি, বরং নারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

তাঁর সাহস ও আত্মবিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

বর্তমানেও বিমান চালনার জগতে নারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাইলট, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার এবং বিমান রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী-এর মধ্যে মাত্র ৪.৯ শতাংশ ছিলেন নারী।

তবে, অ্যামেলিয়ার দেখানো পথে নারীরা এগিয়ে আসছেন, তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে।

অ্যামেলিয়া এয়ারহার্ট শুধু একজন বৈমানিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন নারী মুক্তি ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতীক।

তাঁর জীবন ও কর্ম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, স্বপ্ন দেখতে শেখায় এবং বুঝিয়ে দেয়, আকাশ সবার জন্য উন্মুক্ত।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *