চাকরি হারিয়ে যা হলো: এক ব্যবসায়ীর ফরাসি আঙুর বাগানে নতুন জীবন!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রাক্তন কর্পোরেট পরামর্শদাতা, পিটার হান, কিভাবে বিশাল ব্যবসার জগৎ থেকে দূরে সরে এসে ফ্রান্সের একটি পুরনো আঙ্গুর ক্ষেতে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিলেন, সেই গল্পটি অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণার হতে পারে। প্রায় ২৪ বছর আগে, এক রাতে তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হন, শরীরে ক্লান্তি আর মাথায় অফিসের কাজের চাপ নিয়ে। হঠাৎ করেই তার মনে হয় যেন তিনি দম বন্ধ হয়ে আসছেন।

পিটার হান তখন একজন কর্পোরেট স্ট্র্যাটেজি কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। কাজের চাপে তিনি এতটাই বিপর্যস্ত ছিলেন যে, তার শরীর বিদ্রোহ করতে শুরু করে। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে তিনি ফ্রান্সের লোয়ার ভ্যালি অঞ্চলের একটি পুরনো আঙ্গুর ক্ষেতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে অর্গানিক পদ্ধতিতে ওয়াইন তৈরি করতে শুরু করেন।

নিউ জার্সিতে জন্ম নেওয়া পিটার ছোটবেলায় হংকং, তাইওয়ান এবং সিডনিতে বসবাস করেছেন। সিডনিতে তিনি শেয়ার বাজারে কাজ করতেন, যেখানে প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ ছিল। পরবর্তীতে তিনি যখন কর্পোরেট জগতে প্রবেশ করেন, তখন নিজেকে একজন ‘আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় পর, এই চাকচিক্যপূর্ণ জীবন তাকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। তিনি অনুভব করেন, জীবনের আসল অর্থ যেন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।

নিজের ভেতরের এই শূন্যতা অনুভব করার পরেই তিনি জীবনের নতুন পথ খুঁজতে শুরু করেন। পুরাতন জীবনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা সত্ত্বেও, তিনি বুঝতে পারছিলেন, জীবনে কিছু একটা পরিবর্তন আনা দরকার। এরপর তিনি প্যারিসে ওয়াইন বিষয়ক ক্লাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে ওয়াইনের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। আঙ্গুর ক্ষেতের মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে কাজ করার আগ্রহ তাকে নতুন দিশা দেখায়।

এই আগ্রহ থেকেই তিনি ভিটিকালচার ও এনোলজি (আঙ্গুর উৎপাদন এবং ওয়াইন তৈরি) বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এখানে তিনি ড্যামিয়ান ও ভিনসেন্ট নামে দুই তরুণের সঙ্গে পরিচিত হন, যারা ছিলেন জৈব চাষী। তাদের কাছ থেকে তিনি আঙ্গুর গাছের শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তাদের পরামর্শে তিনি অবশেষে একটি ছোট আঙ্গুর ক্ষেত খুঁজে নেন, যেখানে তিনি জৈব উপায়ে চাষ শুরু করেন।

২০০০ সালের দিকে তিনি ৪ হেক্টর জমির উপর অবস্থিত একটি পুরনো আঙ্গুর ক্ষেত খুঁজে পান। সেই ক্ষেতের সাথেই ছিল প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো একটি বাড়ি, যা সংস্কার করা দরকার ছিল। পিটার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে তার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যান। বর্তমানে, ৬০ বছর বয়সী পিটার, তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়েট এবং তাদের ১৪ বছর বয়সী মেয়ের সঙ্গে সেখানেই বসবাস করেন।

তিনি জানান, একবার একটি অনুষ্ঠানে তার ওয়াইন পরিবেশিত হয়েছিল, যার প্রতি বোতলের দাম ছিল ১০০ পাউন্ডের বেশি। সেই ঘটনায় তিনি প্রথমে গর্ব অনুভব করেছিলেন, কিন্তু পরে তার মনে হয়, এই খ্যাতির প্রতি তার আর কোনো আকর্ষণ নেই। তিনি উপলব্ধি করেন, আগের সেই কর্পোরেট জীবনের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। এখন তিনি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চান, নিজের হাতে কাজ করতে ভালোবাসেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে চান।

পিটার হান মনে করেন, আধুনিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির কাছাকাছি আসার মধ্যেই আসল শান্তি নিহিত। তার মতে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখনকার নয়, বরং কয়েক হাজার বছরের পুরনো। তিনি তার আঙ্গুর ক্ষেতে আধুনিক যন্ত্রপাতির পরিবর্তে ঐতিহ্যপূর্ণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা প্রকৃতির সঙ্গে তার সংযোগ আরও দৃঢ় করে তোলে।

নিজের জীবনের এই পরিবর্তনের কথা তিনি তার ‘এঞ্জেলস ইন দ্য সেলার: নোটস ফ্রম এ ফ্রেঞ্চ ভিনইয়ার্ড’ বইটিতে তুলে ধরেছেন। এই বইয়ে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, জীবনের গভীরতা এবং নিজের ভেতরের শান্তি খুঁজে পাওয়ার গল্প বলেছেন। পিটার হানের এই যাত্রা, যারা জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চান এবং প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য একটি দারুণ উদাহরণ।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *