আমেরিকা: স্বপ্নভঙ্গ? ধনী-গরীবের বিভেদ বাড়ছে!

মার্কিন মুলুকে অর্থনৈতিক বৈষম্য: মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকারে?

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, ‘আমেরিকান ড্রিম’ নামে একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই স্বপ্নের মূল কথা ছিল, কঠোর পরিশ্রমে একজন সাধারণ মানুষও উন্নত জীবন যাপন করতে পারবে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এমনকি দরিদ্র মানুষও চেষ্টা করলে ধনী হতে পারত। কিন্তু ২১ শতকে এসে সেই স্বপ্ন ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমেরিকার শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী লোক দেশটির মোট খরচের প্রায় অর্ধেকটা করে থাকেন। এই তথ্য শুনলে যে কেউ বিস্মিত হবেন।

মুডি’স অ্যানালিটিক্সের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে, আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের (যাদের বার্ষিক আয় কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার) সম্মিলিত খরচ ছিল প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার।

যেখানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী, সেখানে এত অল্প কিছু মানুষের হাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের সুযোগ থাকাটা সত্যিই উদ্বেগের। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আমেরিকার অর্থনীতি মূলত সাধারণ মানুষের চাহিদা ও ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই।

অনেকের কাছেই অবশ্য এই পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক দশক ধরেই এই ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর ভিত দুর্বল হতে শুরু করেছে।

১৯৭০-এর দশকে এর সূচনা হয়, যখন সামাজিক সুরক্ষা ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমানো হয়। একই সময়ে ধনী ও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর জন্য একের পর এক কর ছাড়ের ঘোষণা করা হয়।

এর ফলস্বরূপ, সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যেকার বৈষম্য বাড়ে, এবং দরিদ্র মানুষের পক্ষে সমাজের উপরের স্তরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।

ঐতিহাসিকভাবে, শিল্প উৎপাদন থেকে পরিষেবা খাতে কাজের স্থানান্তর, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কর্মসংস্থানের পরিবর্তন, এবং অনেক কর্মীর চাকরি হারানো – এই সবকিছুই আমেরিকান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।

স্বাস্থ্যখাতে ঋণের বোঝা এবং উচ্চশিক্ষার খরচও এক্ষেত্রে বড় সমস্যা তৈরি করেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, সমাজের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা যেন এটাই চেয়েছিলেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ আমেরিকানদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। সে সময়, ৬০ শতাংশের বেশি আমেরিকান নিজেদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করতেন।

কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও তখন মধ্যবিত্তের কাতারে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন।

কিন্তু ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধের সময় ইসরায়েলকে সমর্থন করায় তেল সংকট দেখা দেয়, যা আমেরিকার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় দেশটির মধ্যাঞ্চলে শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া।

উচ্চ বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে (যাকে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলা হয়) আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নতির দীর্ঘ পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। যদিও অনেকেই মনে করেন, কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কারণে আমেরিকার এই অবস্থা হয়েছে, কিন্তু এর পেছনে আরও গভীর কারণ রয়েছে।

১৯৭০-এর দশকে বৃহৎ কর্পোরেশন, ধনী ব্যক্তি এবং ফেডারেল সরকার – সবাই দরিদ্রতা দূরীকরণের পরিবর্তে সম্পদ নিজেদের দিকে আরও বেশি করে নিতে শুরু করে।

প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনের ‘দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ‘গ্রেট সোসাইটি’ কর্মসূচিগুলো রক্ষণশীলদের চোখে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছিল। তারা মনে করতেন, সরকারের এই পদক্ষেপগুলো সমাজের ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেবে।

এরপর ১৯৮০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের সময়ে সামাজিক সুরক্ষা এবং উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে কঠোরতা আরোপ করা হয়।

রেগান যদিও প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে তিনি রুজভেল্টের ‘নিউ ডিল’-এর সমর্থক, কিন্তু বাস্তবে তিনি সামাজিক কল্যাণমূলক সব নীতির বিরোধিতা করেন।

রেগানের কর নীতি ছিল মূলত ধনী ও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর জন্য সুবিধা নিয়ে আসা।

১৯৫০-এর দশকে ধনী ব্যক্তিরা তাদের আয়ের ওপর সর্বোচ্চ ৯১ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতেন।

১৯৭০-এর দশকে এই হার ছিল ৭০ শতাংশ। রেগান আমলে এই করের হার কমে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ২৮ শতাংশে দাঁড়ায়।

১৯৯০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় সামান্য কিছু কর বাড়ানো হলেও, ততদিনে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল এবং তা আর পূরণ করা যায়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর সংস্কারের ফলে কর্পোরেট করের হার ২১ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল নজিরবিহীন। এসব নীতির কারণে মধ্যবিত্ত, শ্রমিক শ্রেণি এবং দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ধনী ও বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর হাতে চলে যায়।

২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৭৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কর ছাড় এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় সংকোচনের কারণে আমেরিকার দরিদ্র্য ও সাধারণ মানুষের থেকে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী ব্যক্তির হাতে চলে গেছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সম্পদ স্থানান্তরের হার ২০১০-এর দশকে আরও বেড়েছে, যা প্রতি বছর প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল।

অন্যদিকে, সাধারণ আমেরিকানদের জন্য অর্থনীতির অন্যান্য দিকও হতাশাজনক। ২০০৯ সাল থেকে ফেডারেল সর্বনিম্ন মজুরি ছিল ৭.২৫ ডলার, যা এখনো একই আছে।

বিভিন্ন কোম্পানি একত্রিকরণ এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে অধিকাংশ আমেরিকান ভালো বেতনের চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমানে, কর্মরত আমেরিকানদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বছরে ৫০ হাজার ডলারের কম আয় করেন, এবং এক-চতুর্থাংশ কর্মী বছরে ২৫ হাজার ডলারেরও কম আয় করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন যেন ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। তবে পার্থক্য হলো, এখনকার অর্থনীতিতে সমাজের শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের ভোগ-ব্যবহারের প্রভাব অনেক বেশি।

যেখানে অধিকাংশ মানুষের বাড়ি ভাড়া করার, অবকাশ যাপন বা স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য নেই, সেখানে ভোক্তা-অর্থনীতি (consumer capitalism) কিভাবে টিকে থাকবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *