যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিভাজন: ধনী ও গরিবের মধ্যে বাড়ছে ব্যবধান।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে। একদিকে, দেশটির শেয়ার বাজার ঊর্ধ্বমুখী, বাজারে ভালো বিক্রি হচ্ছে এবং প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে।
অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধি, ঋণ পরিশোধে সমস্যা এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এই দুই বিপরীত চিত্র কিভাবে একইসাথে সত্য হতে পারে? বিষয়টি বুঝতে একটি সাধারণ উদাহরণ ব্যবহার করা যেতে পারে – একটি ‘বুরিতো’।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি জনপ্রিয় খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চিপটল (Chipotle), সম্প্রতি তাদের আয়ের হিসাব প্রকাশ করেছে।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, তাদের বিক্রি গত তিন প্রান্তিকে কমেছে।
এর প্রধান কারণ হলো, কম আয়ের ভোক্তারা, যারা মূলত চিপটলের প্রধান গ্রাহক, তাদের কেনাকাটার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন।
চিপটলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্কট বোটরাইট জানিয়েছেন, “আমরা অন্য কোনো প্রতিযোগীর কাছে গ্রাহক হারাচ্ছি না, বরং দেখছি তারা এখন বাইরে খাবার খাওয়া কমিয়ে দোকানে বাজার করা বা বাড়িতে রান্নার দিকে ঝুঁকছে।
কম আয়ের মানুষেরা এখন চাপে আছে এবং আমরাও তাদের এই পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করছি।”
কোম্পানির জরিপে দেখা গেছে, যাদের পরিবারের বার্ষিক আয় এক লাখ ডলারের নিচে, তাদের অনেকেই এখন চিপটলের খাবারকে আগের মতো সাশ্রয়ী মনে করছেন না।
চিপটলের মোট বিক্রয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে এই শ্রেণির গ্রাহকদের কাছ থেকে।
এছাড়া, ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী, যারা চিপটলের বিক্রয়ের ২৫ শতাংশের জন্য দায়ী, তারাও এখন খরচ কমাতে শুরু করেছেন।
অন্যদিকে, কিছু ভোক্তা আছেন যারা আগের মতোই অর্থ খরচ করছেন।
জুতা প্রস্তুতকারক কোম্পানি ক্রোকস (Crocs)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু রীস বলেছেন, “আমাদের উত্তর আমেরিকার কিছু গ্রাহক আছেন, যারা বেশ ধনী।
তারা ক্রোকসসহ অন্যান্য উচ্চ-শ্রেণীর ব্র্যান্ডের পণ্য কিনছেন এবং তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো আছে।
কিন্তু অনেক গ্রাহক আছেন যারা কিছুটা চিন্তিত এবং তাদের আর্থিক অবস্থা ততটা ভালো নয়।
তাই তারা এখন খুব হিসাব করে খরচ করছেন এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।”
কোকা-কোলা-র মতো বড় কোম্পানিগুলোও তাদের আয়ে এই বিভাজন লক্ষ্য করছে।
কোকা-কোলা-র প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হেনরিকে ব্রাউন জানিয়েছেন, তাদের প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড যেমন টোপো চিকো, স্মার্টওয়াটার এবং ফেয়ারলাইফের বিক্রি ভালো হওয়ায় কোম্পানির আয় বেড়েছে।
তবে, কম আয়ের ভোক্তাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে আছে, যা তারা এখনো পরিবর্তন করতে পারেনি।
ব্রাউন আরও জানান, কম আয়ের মানুষের কাছে পণ্য আরও সহজলভ্য করতে এবং একইসাথে প্রিমিয়াম পণ্য বিক্রির কৌশল তারা নিচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা এই পরিস্থিতিকে ‘কে-আকৃতির’ অর্থনীতি বলছেন।
এর মানে হলো, ধনীরা যখন কোনো সমস্যা ছাড়াই খরচ করে যাচ্ছেন, তখন কম আয়ের মানুষ তাদের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলও সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “বড় কোম্পানিগুলোর আয়ের হিসাব শুনলে বোঝা যায়, অর্থনীতিতে একটি বিভাজন তৈরি হয়েছে।
কম আয়ের মানুষজন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং তারা কম কিনছে, সেইসাথে কম দামের পণ্যের দিকে ঝুঁকছে।
কিন্তু উচ্চ আয়ের মানুষেরা আগের মতোই খরচ করছে।”
পরিসংখ্যানও এই কথার প্রমাণ দেয়।
মুডি’স অ্যানালিটিকস-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় উপার্জনকারীরা সামগ্রিক ব্যয়ের একটি বড় অংশ বহন করছেন।
এই বিভাজনের কারণ কী?
ধনী আমেরিকানরা সাধারণত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছেন, যা চলতি বছরে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিও কম এবং তারা বাড়ির মালিক।
অন্যদিকে, কম আয়ের আমেরিকানরা দিন আনে দিন খায় এবং তাদের আয় মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
চাকরি হারালে নতুন চাকরি পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
কারণ, শ্রমবাজার খুব একটা ভালো নয়।
এছাড়া, বাড়ির ভাড়াও বাড়ছে, যা তাদের জন্য আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
এই ‘কে-আকৃতির’ অর্থনীতি সহজে সারানো কঠিন।
মহামারী পরবর্তী কয়েক বছর বাদে, আমেরিকার অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই এই বিভাজন দেখা যাচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর সময় সরকার শ্রমিকদের জন্য কিছু সহায়তা দিয়েছিল, যার ফলে কম আয়ের মানুষেরা সুবিধা পেয়েছিল।
সেই সময়, কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো সম্পদ বৈষম্য কমেছিল।
বিশেষ করে কম আয়ের শ্রমিকদের মজুরিও মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে বেশি ছিল।
সুদের হার কম থাকায় বাড়ির মালিকরা তাদের মর্টগেজ পরিশোধ করতে সুবিধা পেয়েছিল।
কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশি দিন টেকেনি।
সরকারি প্রণোদনার প্রভাব কমে যাওয়ায় অর্থনীতি আবার আগের পথে ফিরে যায়।
মর্টগেজের সুদ বহু বছর আগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কম আয়ের মানুষের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার এখন সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো কমিয়ে দিচ্ছে এবং সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন বাধা তৈরি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য কিছু প্রভাব ফেলতে পারে।
কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার।
তাই, সেখানে ভোক্তাদের ব্যয়ের পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া, বিশ্ব অর্থনীতির এই ধরনের প্রবণতা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণে সহায়তা করতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন
 
                         
                         
                         
                         
                         
                         
				
			 
				
			 
				
			 
				
			