দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে নাৎসি জার্মানির আত্মসমর্পণের সাক্ষী ছিলেন এক মার্কিন সৈনিক। সেই ঘটনার ৮০ বছর পর, এখনো নিজের ঘরে থাকতে পারাটা তার কাছে পরম আনন্দের। লুসিয়ানো “লুই” গ্রাজিয়ানো নামের এই আমেরিকান সৈনিকের বয়স এখন ১০২ বছর।
ফ্রান্সের রেইমসের একটি “ছোট লাল স্কুলঘরে” জার্মান সামরিক কর্মকর্তারা যখন ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করতে রাজি হয়েছিলেন, তখন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন গ্রাজিয়ানো। ধারণা করা হয়, সেই সময়কার জীবিতদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এখনো বেঁচে আছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের দিন, অর্থাৎ ‘ভিক্টরি ইন ইউরোপ’ (ভি-ই) ডে-তে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই গ্রাজিয়ানোর। তার মতে, প্রতিটি দিনই এখন তার কাছে বিশেষ।
বৃদ্ধ বয়সেও, গ্রাজিয়ানো সেই দিনের কথা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন। জার্মানেরা আত্মসমর্পণ করবে কিনা, সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে কেটেছিল সেই সময়টা। তিনি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি অনেকের মুখেই উদ্বেগের ছাপ দেখেছি। টেবিলে জার্মান, ব্রিটিশ ও ফরাসি অফিসাররা ছিলেন।”
তবে, সেই সময় জেনারেল ডুইট ডি. আইজেনহাওয়ার সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন মিত্রবাহিনীর সদর দফতরে। গ্রাজিয়ানো জানান, “আইজেনহাওয়ার ওই ঘরে থাকতে চাননি, যদি তারা (জার্মান) আত্মসমর্পণে রাজি না হতো।”
যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত তরুণ গ্রাজিয়ানো পরে আইজেনহাওয়ারের কাছে পরাজিত জার্মান অফিসারদের নিয়ে যান। তিনি বলেন, “আইজেনহাওয়ার তাদের সঙ্গে হাত মেলাননি। তারা শুধু তাদের বুট দুটি একসঙ্গে শব্দ করে সম্মান জানিয়েছিলেন, এরপর তাদের বিদায় জানানো হয়।”
ইতালীয় অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান গ্রাজিয়ানো নিউইয়র্কের ইস্ট অরোরাতে জন্মগ্রহন করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর পরিবারের সাহায্যার্থে তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। তার মা, বোন এবং ভাই চুল কাটার কাজ করতেন। গ্রাজিয়ানোও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৩ সালে, তার ২০তম জন্মদিনের কয়েক সপ্তাহ আগে, তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শেষে, তিনি কুইন মেরী জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যান। জাহাজের সংকীর্ণ জায়গায় ঘুমানোর বদলে তিনি সমুদ্রের ওপর ডেকে লাইফ জ্যাকেট পরে ঘুমাতেন। কারণ তার মনে হয়েছিল, জাহাজে আক্রমণের শিকার হলে ডেক-এ থাকলে তার বাঁচার সম্ভাবনা বেশি।
ইংল্যান্ডে কয়েক মাস বিভিন্ন কাজে কাটানোর পর, গ্রাজিয়ানো ডি-ডে’র আক্রমণে ওমাহা সমুদ্র সৈকতে যান। তিনি বলেন, “আমি গ্যাসলিন ভর্তি ট্রাক নিয়ে সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলাম। জার্মানরা আমাদের দিকে গুলি চালাচ্ছিল। আমি ফ্ল্যামথ্রোয়ার বের করে মেশিনগান ধ্বংস করি।”
ফ্রান্সে আসার পর গ্রাজিয়ানো ১০২তম ইনফ্যান্ট্রি ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটালিয়নে ইউটিলিটি ফোরম্যান হিসেবে কাজ করেন। এর মানে ছিল, তিনি আমেরিকান-অধিকৃত ভবনগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন, যার মধ্যে ছিল সেই “ছোট লাল স্কুলঘর”।
রেইমসে থাকাকালীন তিনি তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী ইউলা “ববি” শ্যানিফেল্টের সঙ্গে পরিচিত হন, যিনি তখন ছিলেন সেনাবাহিনীর নারী কোরের সার্জেন্ট। তারা রেইমসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং আত্মসমর্পণের পর প্যারিসে হানিমুন করেন। পরে তারা জর্জিয়ার থম্পসনে চলে যান, যেখানে তারা তাদের পরিবার গড়ে তোলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে, গ্রাজিয়ানো আর ফ্রান্সে যাননি। তিনি জানান, “আমাকে অনেকবার সেখানে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে এবং ভ্রমণের খরচ দিতেও রাজি ছিল তারা। কিন্তু আমি আর সেই সমুদ্রে যেতে চাই না।”
ভি-ই ডে উপলক্ষে গ্রাজিয়ানো কোনো বিশেষ আয়োজন করছেন না, তবে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাথে তার এই বিষয়ে কথা বলার কথা রয়েছে। দিনটি তিনি বাড়িতেই কাটাবেন। একজন মানুষ হিসেবে যিনি ইউরোপীয় সংঘাতের অবসানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ভেবেছিলেন, তার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে!
আত্মসমর্পণের মুহূর্তটি স্মরণ করে তিনি বলেন, “আমি সেই ঘরে থাকতে পেরে আনন্দিত ছিলাম। আমি জানতাম, এরপর খুব শীঘ্রই আমি বাড়ি ফিরতে পারব।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন