আলো ঝলমলে রাতের আকাশে তারা দেখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে শহরের জীবনে। কিন্তু যারা রাতের আকাশ ভালোবাসেন, তাদের জন্য এখনও কিছু দারুণ সুযোগ রয়েছে।
আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে এমন কিছু ঐতিহাসিক রেলপথে ট্রেন চলে, যেখানে রাতের বেলা আকাশের তারা দেখা যায়। চলুন, এমনই ১০টি স্বপ্নের মতো স্টারগেজিং ট্রেনের গল্প শোনা যাক।
আলোর দূষণ বাড়ছে, ফলে রাতের আকাশের তারা ক্রমশ আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগও কমেছে।
তবে, আমেরিকার কিছু অঞ্চলের ঐতিহাসিক রেলপথে এখনো রাতের আকাশ তার সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করে। এই ট্রেনগুলো সাধারণত গ্রামীণ অঞ্চল এবং ‘ডার্ক-স্কাই রিজার্ভ’-এর মধ্যে দিয়ে যায়, যেখানে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তার উজ্জ্বলতা নিয়ে এখনো ঝলমল করে।
কোনো কোনো ট্রেনে রয়েছে বিশেষ টেলিস্কোপ, অভিজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অথবা খোলা বগির ব্যবস্থা, যা রাতের আকাশ দেখার সুযোগ করে দেয়।
১. সান্টা ফে স্কাই রেলওয়ে, নিউ মেক্সিকো: এই রুটের আকর্ষণীয় ট্রেনটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হলেন ‘গেম অফ থ্রোনস’ খ্যাত লেখক জর্জ আর. আর. মার্টিন।
ট্রেনটির বগিগুলো সজ্জিত করা হয়েছে অসাধারণ সব চিত্রকর্ম দিয়ে। আড়াই ঘণ্টার ‘স্টারগেজার’ পরিষেবাটি সূর্যাস্তের সময় মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যায়, যেখানে লাইভ মিউজিক এবং ককটেল উপভোগ করার সুযোগ থাকে। এছাড়াও, খোলা বগিতে বসে নভোচারীদের মাধ্যমে রাতের আকাশের তারা সম্পর্কে জানার সুযোগ মেলে।
২. নেভাদা নর্দার্ন স্টার ট্রেন, নেভাদা: ১৯০৫ সালে কপার খনি শিল্পের উন্নতির জন্য এই রেলপথ তৈরি করা হয়েছিল। ‘স্টার ট্রেন’ নামের এই ৩ ঘণ্টার যাত্রাটি ইলি শহর থেকে শুরু হয় এবং ‘গ্রেট বেসিন ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই পার্ক’-এর দিকে যায়।
এখানে রাতের আকাশে আলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রেনের সাদা আলো ব্যবহার করা হয় না। ট্রেনের ভেতরে, জাতীয় উদ্যানের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপের মাধ্যমে তারকাদের সম্পর্কে ধারণা দেন।
৩. ভার্দে ক্যানিয়ন স্টারলাইট, অ্যারিজোনা: ক্লার্কডেল শহর থেকে যাত্রা শুরু করে, এই ট্রেনটি ভার্দে ক্যানিয়নের পাথুরে পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যায়। এখানে আরোহণকারীরা পুরনো দিনের আরামদায়ক বগিতে অথবা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের তারা দেখতে পারেন।
এই ট্রেনের বিশেষত্ব হলো, প্রতিটি স্টারলাইট সার্ভিসে একজন স্থানীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী থাকেন, যিনি নক্ষত্রমন্ডলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।
৪. ওরেগন কোস্ট সিনিক রেলরোড, ওরেগন: একটি পুরনো বাষ্পচালিত লোকোমোটিভ, যা একসময় কাঠ পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো, সেই ট্রেনে চড়ে গারিবাল্ডি থেকে যাত্রা শুরু হয়। ‘ওরেগন কোস্ট মুনলাইট ট্রেন’ আপনাকে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে রাতের আকাশ দেখায়।
বিশেষ করে, চাঁদনি রাতে এই ট্রেন উপকূলীয় বনভূমির মধ্যে দিয়ে যায়, যা রাতের আকাশকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
৫. ক্যাটসিল মাউন্টেন রেলরোড, নিউ ইয়র্ক: ‘টোয়াইলাইট লিমিটেড’ নামের এই ট্রেনটি নিউ ইয়র্কের ক্যাটসিল পর্বতমালায় ধীরে ধীরে চলে। কিংস্টন থেকে যাত্রা শুরু করে ঘন বন এবং কাঠের সেতু পেরিয়ে এটি যায়।
এখানে ইনডোর বগিতে বসার পাশাপাশি, খোলা বগিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য এই ট্রেনে সয়াবিন থেকে তৈরি বায়োডিজেল ব্যবহার করা হয়।
৬. নাপা ভ্যালি ওয়াইন ট্রেন, ক্যালিফোর্নিয়া: সূর্যাস্তের সময় শুরু হওয়া এই ট্রেন যাত্রাটি প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে। ১৯৫০-এর দশকের একটি আরামদায়ক বগিতে বসে, কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে নাপা উপত্যকার ওয়াইন উপভোগ করা যায়।
৭. ওয়ানাম্যাকার, কেম্পটন, অ্যান্ড সাউদার্ন রেলরোড, পেনসিলভানিয়া: প্রতি বছর অক্টোবরে, এই রেলপথে ‘হার্ভেস্ট মুন স্পেশাল’ নামে একটি বিশেষ আয়োজন করা হয়।
এখানে আরোহণকারীরা খোলা বগিতে বসে শরৎকালের পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পারেন।
৮. সারাতোগা করিন্থ অ্যান্ড হাডসন রেলওয়ে, নিউ ইয়র্ক: ‘মুনলাইট মুনশাইন এক্সপ্রেস’-এ চড়ে সূর্যাস্তের সময় যাত্রা শুরু হয়। এটি প্রায় ৩০ মিনিটের পথ অতিক্রম করে হাডসন নদী উপত্যকার একটি খামার বাড়ির দিকে যায়।
গন্তব্যে পৌঁছে, লাইভ মিউজিক, স্থানীয়ভাবে তৈরি মুনশাইন এবং বনফায়ারের আয়োজন করা হয়। ফেরার পথে খোলা বগিতে বসে রাতের আকাশের চাঁদ উপভোগ করা যায়।
৯. স্কঙ্ক ট্রেন, ক্যালিফোর্নিয়া: যারা একটু ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা চান, তাদের জন্য রয়েছে ‘মুনলাইট রেলবাইক’। এই রেলবাইক হলো প্যাডেল-চালিত একটি যান, যা ট্রেনের লাইনে চলে।
গভীর রাতে রেডউড বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় রাতের আকাশের উজ্জ্বল তারা দেখা যায়।
১০. অ্যালেনটাউন অ্যান্ড অবার্ন রেলরোড, পেনসিলভানিয়া: এই ঐতিহ্যবাহী রেলপথে গ্রীষ্মকালে ‘ফায়ারফ্লাই এক্সপ্রেস’ নামে একটি বিশেষ যাত্রা হয়।
এটি কুটসটাউন থেকে যাত্রা শুরু করে, যেখানে আরোহণকারীরা মাঠের মধ্যে ঝলমলে জোনাকি পোকা এবং রাতের আকাশের তারা দেখতে পারেন।
আলোর দূষণ বেড়ে যাওয়ায় রাতের আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
তবে, আমেরিকার এই ট্রেনগুলো এখনো সেই সুযোগটি তৈরি করে রেখেছে, যা ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক