চীনের হান সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, যা আজও আমাদের বিস্মিত করে, তা হলো মাঞ্চেং জেলার লিংশানে আবিষ্কৃত হওয়া এক রাজকীয় সমাধিস্থল। এই সমাধিস্থল যেন চীনের এক উজ্জ্বল অতীতের প্রতিচ্ছবি, যেখানে শায়িত আছেন ঝংশানের যুবরাজ লিউ শেং এবং তাঁর স্ত্রী, দৌ ওয়ান।
তাঁদের সমাধির ভেতরের দৃশ্য, বিশেষ করে মূল্যবান জেড পাথরের তৈরি পোশাক, আজও প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে এক বিস্ময়।
আজ থেকে দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে, বেইজিং থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লিংশান পাহাড়ের পূর্ব ঢালে কয়েক হাজার টন পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল এই সমাধিস্থল। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নির্মিত এই বিশাল সমাধিতে শায়িত ছিলেন হান সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ সম্রাট, চিং-দির পুত্র লিউ শেং এবং তাঁর স্ত্রী।
তাঁদের সমাধির নির্মাণশৈলী যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই সমাধিতে পাওয়া জিনিসপত্রগুলোও অত্যন্ত মূল্যবান। এই সমাধিস্থলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, যুবরাজ ও তাঁর স্ত্রীর সমাধির ভিতরে পাওয়া যাওয়া জেড পাথরের পোশাক, যা চীনের জাতীয় ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লিউ শেং ছিলেন উত্তর চীনের সীমান্ত অঞ্চলের শাসক। তাঁর পিতার রাজত্বকালে বিদ্রোহ দেখা দিলে, তিনি এই অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করেন। সম্ভবত ক্ষমতা গ্রহণের পরেই এই সমাধিস্থলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। যুগ যুগ ধরে সমাধিস্থলটি অক্ষত ছিল, যা এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
১৯৬০-এর দশকে, চীনের তৎকালীন শাসক মাও সেতুংয়ের আমলে, একদল সেনা লিংশান পাহাড়ের ঢালে বিমান হামলার আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির জন্য খনন কাজ শুরু করে। সেই সময় তারা এক পাথরের দেওয়াল ভেঙে ফেলে, যা আসলে ছিল একটি সমাধিকক্ষের প্রবেশপথ। এরপর শুরু হয় আসল অভিযান।
জরুরি ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিক দল গঠন করা হয় এবং সমাধিস্থলের খননকাজ চলতে থাকে। খুব দ্রুতই তাঁরা বুঝতে পারেন যে এটি একটি প্রাচীন সমাধিস্থল। খননকার্য্যের সময়, সমাধির কাছাকাছি আরেকটি সমাধির সন্ধান পাওয়া যায়।
দুটি সমাধির গঠন প্রায় একই রকম ছিল। সংকীর্ণ পথ দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে একটি বিশাল কক্ষে যাওয়া যেত। এই কক্ষের উত্তরে খাবার রাখার স্থান ছিল, যেখানে মৃত ব্যক্তির পরকালের জন্য খাদ্যসামগ্রী রাখা হত। দক্ষিণে ছিল অশ্বশালা, যেখানে রথ এবং ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল, যা সেই সময়ের অভিজাতদের ক্ষমতার প্রতীক ছিল।
মাঝের স্থানটি ছিল আনুষ্ঠানিক হলঘর, যেখানে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছিল। হলঘরের পেছনে ছিল পাথরের তৈরি দরজা, যা সমাধিকক্ষে যাওয়ার পথ খুলে দিত।
এই সমাধিস্থলের সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার ছিল জেড পাথরের পোশাক। ধারণা করা হয়, এই পোশাক মৃতের আত্মাকে রক্ষা করত এবং তাদের অমরত্বে সাহায্য করত। পোশাকগুলো হাজার হাজার জেড পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, যা সোনার সুতা দিয়ে একত্রে বাঁধা ছিল। প্রত্যেকটি পোশাক শরীরের আকার অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল।
প্রাচীন চীনা সংস্কৃতিতে আত্মার ধারণা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের দুটি আত্মা থাকে: ‘হুন’ এবং ‘পো’। ‘হুন’ হলো মানসিক আত্মার প্রতীক, যা মৃত্যুর পর স্বর্গে চলে যায়। অন্যদিকে, ‘পো’ হলো শারীরিক আত্মার প্রতীক, যা দেহের সঙ্গেই থাকে।
জেড পাথরের পোশাক সম্ভবত ‘পো’-কে আবদ্ধ করে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে তা কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
লিউ শেং এবং তাঁর স্ত্রীর সমাধিস্থল আবিষ্কারের ফলে হান সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার চীনের প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আজও গবেষকদের কাছে গবেষণার এক বিশাল ক্ষেত্র।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক