মায়া সভ্যতার এক প্রাচীন শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে এক রহস্যময় বেদি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় ১,৭০০ বছর আগের এই বেদীর গঠনশৈলী এবং এর ভেতরের কিছু বিষয় সেই সময়ের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এক গভীর ইঙ্গিত দেয়।
সম্প্রতি ‘অ্যান্টিভিটি’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
মধ্য আমেরিকার দেশ গুয়াতেমালার অন্তর্গত টিকাল নামক প্রাচীন মায়া শহরে এই বেদিটি পাওয়া গেছে। কিন্তু এর নির্মাণশৈলী পরীক্ষা করে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, এটির কারিগররা মায়া ছিলেন না।
তাঁদের ধারণা, এই বেদীর অলঙ্করণ করা হয়েছে প্রায় ৬৩০ মাইল দূরে, মেক্সিকো সিটির কাছে অবস্থিত তেওতিহুয়াকান শহর থেকে আসা শিল্পীদের দ্বারা। তেওতিহুয়াকান ছিল সেই সময়ের একটি শক্তিশালী জনপদ, যা ওই অঞ্চলের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করত।
এই আবিষ্কারের আগে, গবেষকরা জানতেন যে মায়া এবং তেওতিহুয়াকান সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ ছিল, তবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কটি কেমন ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। নতুন এই বেদীর আবিষ্কার সেই সম্পর্কে নতুন তথ্য যোগ করেছে।
বেদীর নিচে দুটি মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং অন্যজন সম্ভবত ২ থেকে ৪ বছর বয়সী একটি শিশু।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং মায়া সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ স্টিফেন হিউস্টন এই বিষয়ে বলেন, “এই বেদি প্রমাণ করে যে তেওতিহুয়াকানের ধনী শাসকরা টিকালে এসেছিল এবং তাদের নিজস্ব শহরের মতো ধর্মীয় স্থান তৈরি করেছিল।” তিনি আরও যোগ করেন, “এটি তেওতিহুয়াকানের গভীর প্রভাবের প্রমাণ।”
২০১৯ সালে, হিউস্টন এবং তাঁর সহকর্মীরা এই স্থানে খনন কাজ শুরু করেন। এলাকার স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে তাঁরা মাটির নিচে কিছু কাঠামোর সন্ধান পান, যা প্রথমে একটি প্রাকৃতিক ঢিবি বলে মনে করা হয়েছিল।
খনন কাজের সময়, তাঁরা এই বেদিটি খুঁজে পান। বেদীর গায়ে পালকযুক্ত শিরস্ত্রাণ পরিহিত একজন ব্যক্তির অস্পষ্ট চিত্র এবং উজ্জ্বল লাল, কালো ও হলুদ রঙের ছোঁয়া এখনো দেখা যায়। এই নকশাটি তেওতিহুয়াকান সংস্কৃতির ‘ঝড় দেবতা’র চিত্রের সঙ্গে মিলে যায়, যা মায়া শিল্পকর্মে খুব একটা দেখা যায় না।
গবেষকরা জানান, বেদীর নিচে দুটি দেহাবশেষের সঙ্গে আরও তিনটি শিশুর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। শিশুদের সমাধিস্থ করার পদ্ধতিও তেওতিহুয়াকানের রীতি অনুযায়ী করা হয়েছিল।
গবেষকদের মতে, এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুশীলনগুলো টিকালের উপর তেওতিহুয়াকানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু শেরার বলেছেন, “মায়া সভ্যতা সাধারণত তাদের পুরনো স্থাপনাগুলো ভেঙে তার উপরে নতুন করে নির্মাণ করত। কিন্তু এখানে, তারা বেদি এবং আশেপাশের ভবনগুলো মাটির নিচে পুঁতে দিয়েছে এবং সেগুলোকে সেভাবেই রেখে দিয়েছে।
সম্ভবত তেওতিহুয়াকানের প্রভাবের প্রতি তাদের জটিল অনুভূতি ছিল।”
আগের কিছু গবেষণায় জানা গেছে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে তেওতিহুয়াকান মায়া অঞ্চলের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল। এমনকি তারা মায়া রাজার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজেদের পছন্দের একজন শাসককে সেখানে বসিয়েছিল।
অধ্যাপক হিউস্টন আরও বলেন, “সম্রাজ্যগুলো সব সময়ই সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করে। স্প্যানিশরা আসার পর আজটেক সভ্যতার কী হয়েছিল, তা সবাই জানে। তেওতিহুয়াকানও মায়া অঞ্চলের সম্পদ, বিশেষ করে পাখির পালক, জেড এবং চকলেটের লোভে সেখানে প্রবেশ করতে চেয়েছিল।”
তাদের কাছে মায়া অঞ্চল ছিল যেন এক ‘সোনার দেশ’।
তথ্য সূত্র: CNN