মানবদেহের গঠন এবং বিকাশে প্রাচীন ভাইরাসের ডিএনএ’র ভূমিকা!
আমাদের শরীরে, যা আমাদের মানুষ হিসেবে পরিচিত করে, তার প্রায় ৮ শতাংশ ডিএনএ-র উৎস হল কয়েক কোটি বছর আগের ভাইরাস। এই তথ্য সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে। মানুষের ডিএনএ-এর এই অংশে, যা ট্রান্সপোজিবল এলিমেন্ট বা টিই (TE) নামে পরিচিত, সেগুলি ‘জাম্পিং জিন’ নামেও পরিচিত।
কারণ এই টিইগুলি নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে এবং জিনোমের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম। আগে এই টিইগুলিকে ‘জাঙ্ক’ ডিএনএ হিসেবে বিবেচনা করা হত, অর্থাৎ এদের কোনো জৈবিক কাজ নেই বলেই মনে করা হতো। কিন্তু নতুন গবেষণা সেই ধারণা বদলে দিয়েছে।
জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. ফুমিটাকা ইনোয়ে বলেছেন, “আমাদের জিনোম বহু আগে চিহ্নিত করা হয়েছে, তবে এর অনেক অংশের কাজ এখনো অজানা। ট্রান্সপোজিবল এলিমেন্টগুলি জিনোমের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং গবেষণা যত এগোবে, এর গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হবে।”
গবেষকরা টিইগুলির সিকোয়েন্সিং বা বিন্যাস বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এরা আসলে জিন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জিন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াটি হল, কখন একটি জিন সক্রিয় হবে বা বন্ধ হয়ে যাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা।
এই আবিষ্কার মানুষের বিবর্তন, রোগ এবং জিন থেরাপির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। চীনের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সাংহাই ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনিটি অ্যান্ড ইনফেকশনের প্রধান গবেষক ড. জুন চেন এই বিষয়ে বলেছেন, “আমরা আশা করি, টিইগুলি, বিশেষ করে এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস (ইআরভি) কীভাবে আমাদের মানুষ হিসেবে তৈরি করেছে, তা উন্মোচন করতে পারব।”
ভাইরাস যখন আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের আক্রমণ করত, তখন ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানগুলো নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে হোস্টের ক্রোমোজোমের বিভিন্ন স্থানে প্রবেশ করত। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজিস্ট ড. লিন হে-এর মতে, “প্রাচীন ভাইরাসগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের জিনোমে প্রবেশ করতে খুবই কার্যকর ছিল এবং তাদের ধ্বংসাবশেষ আমাদের জিনোমের একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে।
আমাদের জিনোম এই ভাইরাসগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের ক্ষতিকর প্রভাব দূর করতে বিভিন্ন কৌশল তৈরি করেছে।
যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এই প্রাচীন ভাইরাসগুলো নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ট্রান্সপোজিবল এলিমেন্ট মানুষের শরীরে রোগের কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে টিইগুলিকে নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে।
ড. হে আরও যোগ করেন, “বিবর্তনের ধারায় কিছু ভাইরাস হয়তো দুর্বল হয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার কিছু ভাইরাসকে আমাদের শরীর নিজেদের কাজে লাগিয়েছে, যা জিনোমের নতুনত্বে সহায়তা করে।”
নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ ধরনের টিই, যাকে ‘এমইআর১১’ (MER11) বলা হয়, তার ওপর আলোকপাত করেছেন। এই টিই প্রাইমেট বা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জিনোমে পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা নতুন একটি শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি ব্যবহার করে ডিএনএ-এর কার্যকলাপ পরীক্ষা করেছেন এবং এর মাধ্যমে চারটি অজানা উপশ্রেণী খুঁজে বের করেছেন। এর মধ্যে ‘এমইআর১১_জি৪’ (MER11_G4) নামের একটি উপশ্রেণী মানব স্টেম সেল এবং প্রাথমিক পর্যায়ের নিউরাল কোষে জিন প্রকাশের ক্ষমতা রাখে।
কিয়োটো ইউনিভার্সিটির মতে, এই আবিষ্কারটি মানব বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে এই টিই-এর ভূমিকা নির্দেশ করে এবং এটি “জিন কীভাবে পরিবেশের সংকেতের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে”।
গবেষকরা আরও মনে করেন, ভাইরাল টিইগুলি মানব বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সময়ের সঙ্গে ডিএনএ-এর পরিবর্তনগুলি পর্যবেক্ষণ করে, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে এই উপশ্রেণীটি বিভিন্ন প্রাণীর জিনোমে ভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে, যা মানুষ, শিম্পাঞ্জি এবং ম্যাকাও বানরের মতো প্রজাতি তৈরিতে সহায়তা করেছে।
তবে, এই টিইগুলি কীভাবে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ড. জুন চেনের মতে, সম্ভবত অন্যান্য অজানা টিইও প্রাইমেটদের বিবর্তনে ভিন্ন ভূমিকা পালন করেছে। জার্মানির লাইবনিজ ইনস্টিটিউট অন এজিং-এর কম্পিউটার বায়োলজিস্ট ড. স্টিভ হফম্যানের মতে, “এই গবেষণা আমাদের জিনোম কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তা বুঝতে সাহায্য করে।”
গবেষণা থেকে জানা যায়, মানুষের কিছু রোগের কারণ হলো ডিএনএ-এর এই বিশেষ বিন্যাস। এই গবেষণার মাধ্যমে, ভবিষ্যতে রোগের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন