চোখ বন্ধ করুন, আপেলটি কি দেখতে পাচ্ছেন? না পারলে, এই রোগ হতে পারে!

মনের চোখে ছবি আঁকা: আপনি কি কোনো আপেল কল্পনা করতে পারেন? যদি না পারেন, তাহলে এই অবস্থা আপনারও হতে পারে।

চোখ বন্ধ করে একটি আপেলের কথা ভাবুন তো! আপেলটির আকার কেমন? রং কী? সেটি কি বাতাসে ভাসছে, নাকি কেউ ধরে আছে, নাকি টেবিলের উপর রাখা আছে? যদি এই ছবিগুলো আপনার মনে আনতে অসুবিধা হয়, তাহলে সম্ভবত আপনি ‘এফ্যান্টাসিয়া’ নামক একটি অবস্থার শিকার। সম্প্রতি এই শব্দটির জন্ম হয়েছে।

যাদের ‘এফ্যান্টাসিয়া’ আছে, তারা তাদের ‘মনের চোখে’ কোনো দৃশ্য সঠিকভাবে দেখতে পান না। তাদের হয়তো দারুণ কল্পনাশক্তি রয়েছে, তারা সৃজনশীল জীবনও যাপন করেন, তবে দৃশ্যকল্পনার ক্ষেত্রে তাদের মস্তিষ্ক অন্যদের থেকে খানিকটা আলাদাভাবে কাজ করে।

প্রায় ২৫ বছর আগে, ইউনিভার্সিটি অফ এক্সেটারের (বর্তমানে এডিনবার্গ সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল ব্রেইন সায়েন্সেস-এর সম্মানীয় ফেলো) অধ্যাপক অ্যাডাম জেম্যান-এর কাছে এমন একজন মানুষের কথা আসে যিনি একটি হৃদরোগের অস্ত্রোপচারের পর দৃশ্যকল্পনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আগে যার মনের চোখে স্পষ্ট ছবি ভেসে উঠত, সেই মানুষটির এমন পরিবর্তনে জেম্যান-এর কৌতূহল জাগে। মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরের চিত্রকল্পনার প্রক্রিয়াটি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হয়।

২০১০ সালে প্রকাশিত জেম্যানের গবেষণায় দেখা যায়, এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। যাদের হঠাৎ করে দৃশ্যকল্পনা ক্ষমতা হারায়নি, বরং আগে থেকেই এই ক্ষমতা ছিল না, এমন অনেকেই গবেষণার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা জানান, গবেষণাটিতে রোগীর বর্ণনা পড়ার পর তারা বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের আসলে কখনোই দৃশ্যকল্পনার ক্ষমতা ছিল না।

জেম্যান এদের মধ্যে ২১ জনকে নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তিনি তাদের এই অবস্থার নাম দেন ‘এফ্যান্টাসিয়া’। গ্রিক শব্দ ‘ফ্যান্টাসিয়া’-র সঙ্গে মিল রেখে এই নামটি দেওয়া হয়, যার অর্থ হল ‘কল্পনা’।

মানসিক চিত্রকল্পনা পরিমাপের জন্য মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করা হতো। তবে জার্মানির রুহর ইউনিভার্সিটি বোখুম-এর পিএইচডি ছাত্র ক্রিশ্চিয়ান শোলজ-এর মতে, এই ধরনের পদ্ধতি অনেক সময় সন্দেহের জন্ম দেয়।

যারা এফ্যান্টাসিয়ার শিকার নন, তারা অনেক সময় মনে করেন, মানসিক ছবি তৈরি করার ক্ষমতাটাই আসল, কিন্তু এর বর্ণনা দেওয়ার ধরন ভিন্ন হতে পারে। শোলজ বলেন, “যাদের মানসিক চিত্রকল্পনা খুব স্পষ্ট, তাদের মধ্যে এফ্যান্টাসিয়া নিয়ে সন্দেহ বেশি দেখা যায়।” যাদের সারা জীবন ধরে দৃশ্যকল্পনার অভ্যাস, তাদের পক্ষে অন্য কারো এই ক্ষমতা না থাকাটা বিশ্বাস করা কঠিন।

সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা তাদের মধ্যেকার শারীরিক পার্থক্য পরীক্ষা করতে পেরেছেন, যারা শক্তিশালী দৃশ্যকল্পনা করেন এবং করেন না। জেম্যান ব্যাখ্যা করেন, “যদি আপনি সূর্যের দিকে তাকান, আপনার চোখের মণি সংকুচিত হয়। যদি আপনি কোনো দৃশ্যকল্পনা করেন, যেমন সূর্যের দিকে তাকানোর কথা ভাবেন, তখনও আপনার চোখের মণি সংকুচিত হবে—কিন্তু এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।”

২০২১ সালের একটি গবেষণায়, অংশগ্রহণকারীদের আঙুলের ডগায় সেন্সর লাগানো হয়েছিল, যা তাদের আবেগগত উত্তেজনার পরিবর্তন পরিমাপ করে। কিছু অংশগ্রহণকারীকে একটি ভয়ের গল্প শোনানো হয়েছিল, আবার কয়েকজনকে ভয়ের ছবি দেখানো হয়েছিল। যাদের শক্তিশালী মানসিক চিত্রকল্পনা রয়েছে, তাদের একটি নিয়ন্ত্রণমূলক দলের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তরা গল্পের প্রতি ভয়ের প্রতিক্রিয়া জানায়নি, যদিও ছবিগুলোর প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া একই ছিল। এর থেকে গবেষকরা ধারণা করেন, মানসিক চিত্রকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা গল্প শোনার মতো ধারণাগত বিষয়ের সঙ্গে শ্রোতার মানসিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে।

এ বছর প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় এমআরআই স্ক্যান ব্যবহার করে ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স-এর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের মস্তিষ্কেও দৃশ্যকল্পনা হতে পারে, তবে তা এত কম যে সচেতন মন সেটিকে উপলব্ধি করতে পারে না। জেম্যান ব্যাখ্যা করেন, “যাদের হাইপারফ্যান্টাসিয়া বা অতিমাত্রায় দৃশ্যকল্পনা করার ক্ষমতা আছে, তাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশের সঙ্গে ভিজ্যুয়াল নেটওয়ার্ক-এর শক্তিশালী সংযোগ দেখা যায়, যা এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের মধ্যে কম থাকে।”

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান ও মস্তিষ্ক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সারা শমস্টাইন বলেন, এই অবস্থা কোনো অক্ষমতা নয় এবং এটি মানুষের উপলব্ধি ও কল্পনার বিবর্তনকে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। “এখানে কোনো ক্ষতি নেই, কোনো ঘাটতিও নেই। এটি তথ্য প্রক্রিয়াকরণের একটি ভিন্ন উপায়, যা মস্তিষ্কের সংযোগ অথবা সক্রিয়করণের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনের কারণে হতে পারে। এটি সম্ভবত একটি অভিযোজনমূলক বৈশিষ্ট্য,” তিনি বলেন।

শমস্টাইন মনে করেন, এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের মস্তিষ্ক দৃশ্যসংক্রান্ত উদ্দীপনা ভিন্নভাবে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে—যা সচেতন মনকে এড়িয়ে মস্তিষ্কের অন্য অংশে পরিচালিত হয়। যদি এটি একটি অভিযোজনমূলক বৈশিষ্ট্য হয়, তবে ভবিষ্যতে সম্ভবত জনসংখ্যার একটি বড় অংশে এটি দেখা যেতে পারে।

শমস্টাইন নিজেও আপেলের পরীক্ষার মাধ্যমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার মানসিক চিত্র তৈরি করার ক্ষমতা অন্যদের থেকে আলাদা। যদিও তিনি দীর্ঘদিন ধরে জ্ঞানীয় স্নায়ুবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন এবং ‘এফ্যান্টাসিয়া’ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনাকে বিজ্ঞানসম্মত মনে করেননি।

এর মানে এই নয় যে, তিনি বা এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্ত অন্য কারো কল্পনাশক্তি নেই। বরং তারা অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারেন। “আমি অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারি, জটিল চিত্র তৈরি করতে পারি। তবে সেটা দৃশ্য আকারে নয়। আমার জন্য সবকিছুই কালো—কিন্তু আমার একটি ধারণা আছে, আমি সেটিকে মানসিক রূপ দিই,” তিনি বলেন।

জেম্যানের অনুমান, সারা বিশ্বে কয়েক মিলিয়ন মানুষের এফ্যান্টাসিয়া রয়েছে। তাহলে কেন এই অবস্থা সম্পর্কে এত কম জানা যায়?

২০১৫ সালে এই শব্দটির জন্ম হলেও, বিজ্ঞানীরা বহু শতাব্দী ধরে উপলব্ধি ও স্মৃতির পার্থক্য নিয়ে গবেষণা করছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মনোবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গ্যালটন ১৮৮০ সালে একটি প্রশ্নপত্র বিতরণ করেন, যাতে দেখা যায় ১০০ জন পুরুষের মধ্যে ১২ জন তাদের সকালের নাস্তার টেবিল কল্পনা করতে পারেন না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শেলের আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের চিকিৎসা করা বিশিষ্ট মনোবিদ ডব্লিউ এইচ আর রিভার্স-এরও দৃশ্যকল্পনার ক্ষমতা ছিল না। তিনি ধারণা করেছিলেন, শৈশবের কোনো আঘাতের কারণে তিনি এই ক্ষমতা হারিয়েছেন।

তবে সে সময় আনুষ্ঠানিক গবেষণায় এই পর্যবেক্ষণগুলো নিশ্চিত করা যায়নি। এফ্যান্টাসিয়া নেটওয়ার্ক কমিউনিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা টম এবের-এর মতে, এই অবস্থার তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় না বলেই হয়তো এটিকে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষা করা হয়েছে।

এবের আরও বলেন, এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্ত এবং দৃশ্যকল্পনাকারী—উভয় দলের মানুষের জীবনেই খুব সাধারণ অভিজ্ঞতা থাকে। এফ্যান্টাসিয়া নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটে আসা হাজার হাজার মানুষ তাদের ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মাত্রা চিহ্নিত করতে এবং এফ্যান্টাসিয়ার ব্যাপকতা সম্পর্কে তথ্য দিতে ‘ভিভিডনেস অফ ভিজ্যুয়াল ইমেজারী কোয়েশ্চনিয়ার’ পূরণ করেছেন।

এবের-এর মতে, ৬০,০০০ সদস্যের এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা শিল্পী, স্থপতি, লেখক এবং অন্যান্য দৃশ্যকল্পনা নির্ভর পেশায় কাজ করেন। এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্ত এবং দৃশ্যকল্পনাকারী উভয়ই তাদের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের মুখ চিনতে পারেন এবং পরিচিত জায়গায় যাওয়া-আসা করতে পারেন।

এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের আরেকটি মিলনস্থল হল ‘/r/Aphantasia’ নামের একটি রেডডিট কমিউনিটি, যেখানে ৭০,০০০-এর বেশি সক্রিয় সদস্য তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন এবং এই অবস্থা নিয়ে নতুন গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেন।

এই সম্প্রদায়ের একজন সদস্য বলেছেন, “আমি সবসময় ভেবেছি, মানুষ যখন ঘুমের জন্য ‘ভেড়া গণনা’ করে বা ‘দর্শককে নগ্ন অবস্থায় কল্পনা করে’, তখন তারা আসলে রূপক অর্থে কথা বলছে।”

আরেকজন সদস্য জানান, “ইন্টারনেটে এই বিষয়টা আসার আগে আমি বুঝতেই পারিনি যে, আমি অন্যদের থেকে আলাদা।”

তবে, এবের-এর এফ্যান্টাসিয়া নেটওয়ার্কের কিছু সদস্য মনে করেন, মনের চোখে ছবি দেখতে না পাওয়ার কারণে তারা অতীতের অনেক স্মৃতি স্পষ্টভাবে উপভোগ করতে পারেন না।

এবের বলেন, “আমার মনে হয়, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব অনুভব করে। আপনি অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো পুনরায় উপভোগ করার, এমনকি আপনার প্রিয়জনদের মনের চোখে দেখার রোমান্টিকতা অনুভব করতে পারেন, যা এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।”

জেম্যান নিশ্চিত করেছেন যে, “সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, এফ্যান্টাসিয়া আক্রান্তদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা হল তাদের দুর্বল স্মৃতিশক্তি।”

এফ্যান্টাসিয়া সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ কী? বিশ্বের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত, তারা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে এবং গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কাজ করছেন।

জেম্যান বলেন, “এটি একটি আকর্ষণীয় অদৃশ্য পার্থক্য, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করি, তবে অন্যদের অভিজ্ঞতা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে।”

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *