আর্জেন্টিনার ‘ডাস্টবিনের’ পেঙ্গুইন: বাঁচার অদম্য গল্প!

আর্জেন্টিনার একটি দূষিত সৈকতে ম্যাগেলানিক পেঙ্গুইনদের টিকে থাকার সংগ্রাম, যা আমাদের অনেক কিছু শেখায়।

আর্জেন্টিনার একটি প্রত্যন্ত উপকূল, যেখানে আবর্জনার স্তূপের মাঝে বাসা বেঁধেছে কিছু ম্যাগেলানিক পেঙ্গুইন। শুনলে হয়তো অবাক হবেন, কিন্তু এটাই সত্যি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন অভিযাত্রী পাবলো “পপি” বোরবোরোগ্লু ২০০৮ সালে প্রথম এই জায়গাটি পরিদর্শন করেন। তিনি দেখেন, সেখানে ভাঙা কাঁচ, পরিত্যক্ত গাড়ি এবং পোড়া ক্যাম্পফায়ারের ধ্বংসাবশেষ। জায়গাটা যেন একটা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এই দূষিত পরিবেশের মাঝেই তিনি খুঁজে পান এক বিস্ময়কর দৃশ্য—১২টি ম্যাগেলানিক পেঙ্গুইন, যাদের প্রত্যেকের চোখের চারপাশে সাদা একটি রেখা এবং গলায় সাদা ব্যান্ড রয়েছে। এরা সবাই সেখানে বসবাস করছে। সাধারণত, ম্যাগেলানিক পেঙ্গুইনরা দক্ষিণ আমেরিকার পাথুরে এবং বালুকাময় সৈকতে প্রজনন করে, শীতকালে তারা উত্তরে ব্রাজিল ও পেরু পর্যন্ত পরিযাণ করে। কিন্তু এখানে, মূল উপনিবেশ থেকে ৮০ মাইলেরও বেশি দূরে, তারা তাদের আবাস তৈরি করেছে।

পপি দ্রুত কাজ শুরু করেন। তিনি সেখানকার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্লাস্টিকে আটকে পড়া একটি পেঙ্গুইনকে উদ্ধার করেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে এলাকাটি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই প্রতিকূল পরিবেশে শুধু যে পেঙ্গুইনগুলো টিকে ছিল তাই নয়, তারা তাদের বাচ্চা বড় করতেও সক্ষম হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নতুন পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষেত্রে পেঙ্গুইনদের এই ক্ষমতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

পেঙ্গুইনরা সত্যিই অসাধারণ প্রাণী। তাদের বিশেষ শারীরিক গঠন, যেমন—টুক্সিদোর মতো দেখতে, এবং বাচ্চার প্রতি তাদের ভালোবাসাই তাদের সংরক্ষণের প্রতীক হিসেবে পরিচিত করেছে। প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে, আজকের নিউজিল্যান্ডে প্রথম পেঙ্গুইনের আবির্ভাব ঘটেছিল। সময়ের সাথে সাথে, তারা বিভিন্ন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখেছে। কিছু প্রজাতি যেমন—সম্রাট ও অ্যাডেলী পেঙ্গুইন, যারা অ্যান্টার্কটিকায় বাস করে, তারা ঠান্ডা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য শরীরের ফ্যাট এবং পালকের একটি বিশেষ স্তর তৈরি করেছে। আবার, গ্যালাপাগোস পেঙ্গুইন, যারা নিরক্ষরেখার কাছাকাছি অঞ্চলে বাস করে, তারা উষ্ণ জলবায়ুর সাথে মানানসই হালকা গড়নের অধিকারী হয়েছে।

তবে, বর্তমানে অনেক পেঙ্গুইন প্রজাতিই নানা ধরনের হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বে প্রায় অর্ধেক পেঙ্গুইন প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছর, আফ্রিকান পেঙ্গুইনদেরকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সমুদ্র এবং স্থলভাগে তাদের জীবন এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সমুদ্রে তেল নিঃসরণ, শৈবালের বিস্তার, মাছ ধরার জাল এবং প্লাস্টিক দূষণ তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। অন্যদিকে, উপকূলে, যেখানে তারা প্রজনন করে, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন, উপকূলীয় উন্নয়ন এবং শিকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, পেঙ্গুইনদের বিবর্তনের গতি কমে গেছে, যা তাদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা তৈরি করছে। তারপরও, কিছু প্রজাতি তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়ে নতুন অঞ্চলে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্রাট পেঙ্গুইনরা যখন তাদের অঞ্চলের বরফ নির্ভরযোগ্য থাকে না, তখন তারা নতুন স্থানে চলে যায়। এছাড়া, কিং পেঙ্গুইনরা কিছু অঞ্চলে হ্রাস পেলেও, অন্য জায়গায় তাদের সংখ্যা বাড়ছে। গেণ্টু পেঙ্গুইনরা খাদ্যের সন্ধানে দক্ষিণ মহাসাগরের উষ্ণতা এবং বরফমুক্ত এলাকার দিকে যাচ্ছে।

আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়ার দূষিত সৈকতে বসবাসকারী ম্যাগেলানিক পেঙ্গুইনদের এই টিকে থাকার গল্প অন্যদেরও উৎসাহিত করেছে। বোরবোরোগ্লু স্থানীয় ভূমি মালিক ও সরকারের সঙ্গে মিলে প্রায় ৩৫,০০০ একর জায়গা জুড়ে একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য তৈরি করেছেন। বর্তমানে এখানে ৮,০০০ এর বেশি পেঙ্গুইন বাস করে। এটি প্রকৃতির টিকে থাকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *