মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে আসিয়ান (ASEAN) দেশগুলো, চীন এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদভুক্ত (GCC) দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে নতুন এক অর্থনৈতিক মেরুকরণের আভাস পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
কারণ এই জোটের সম্মিলিত অর্থনৈতিক শক্তি এবং বাণিজ্য সম্ভাবনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করা। বিশেষভাবে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আসিয়ান এবং চীনের মধ্যে বিদ্যমান মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলকে আরও উন্নত করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া, চীন এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এই দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি (GDP) প্রায় ২৪.৮৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২.১৫ বিলিয়ন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এই সম্মেলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন, এই বিশাল বাজারের সমন্বয়ে উদ্ভাবন বৃদ্ধি এবং আন্তঃআঞ্চলিক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই জোট বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি অন্যদিকে চীন ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের এই উত্থান উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।
আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসঙ্গে, আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সাল পর্যন্ত আসিয়ান এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর ফলে, উপসাগরীয় দেশগুলো আসিয়ানের পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়ার সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর বাণিজ্য ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও (Foreign Direct Investment – FDI) উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আসিয়ানে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে।
এর মধ্যে শুধু মালয়েশিয়াতেই এসেছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও মালয়েশিয়ার উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে।
তবে, চীনের সঙ্গে আসিয়ানের বাণিজ্য বাড়লেও, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এখনো অনেক দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো আসিয়ানের দেশগুলোর জন্য বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে, আসিয়ানের রপ্তানির ১৫ শতাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে, যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ বেশি।
সেন্টার ফর মার্কেট এডুকেশনের (CME) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কারমেলো ফেরলিতো-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ানে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানে রয়েছে।
২০২৩ সালে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানে সম্মিলিতভাবে করা যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের প্রায় দ্বিগুণ।
আলোচনায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতিও উঠে আসে। সম্মেলনে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা এবং যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
একইসঙ্গে, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হয় এবং সংঘাত বন্ধের জন্য একটি যুদ্ধবিরতি প্রসারিত করার আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশের জন্য এই সম্মেলন এবং এর ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষ করে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রসার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এছাড়াও, বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা