মহাকাশে ভেসে বেড়ানো পাথর, তারা ঝলমলে উল্কা এবং উজ্জ্বল ধূমকেতু – এগুলো রাতের আকাশে প্রায়ই দেখা যায়, যা আমাদের কৌতূহল জাগায়। এদের মধ্যে কোনটি আসলে কী, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়।
কোনো কোনোটি কি পৃথিবীর জন্য সত্যি বিপদ ডেকে আনতে পারে? আসুন, এই বিষয়ে কিছু জরুরি তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
মহাকাশের পাথর (Space Rocks):
মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো কঠিন বস্তুগুলোকেই সহজ কথায় ‘মহাকাশের পাথর’ বলা হয়। এগুলো মূলত পাথর ও খনিজ দ্বারা গঠিত হলেও, এদের মধ্যে ধাতু বা বরফও থাকতে পারে।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – গ্রহাণু, উল্কাপিণ্ড এবং ধূমকেতু।
এই মহাকাশীয় বস্তুগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীদের এত আগ্রহ কেন? কারণ, এদের মধ্যে কিছু কিছু সময়ে পৃথিবীর বুকে এসে আঘাত হানে।
আর এর মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা মহাকাশ এবং আমাদের সৌরজগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারেন।
গ্রহাণু, উল্কা এবং ধূমকেতুর মধ্যে পার্থক্য:
গ্রহাণু (Asteroid): এগুলো হলো সৌরজগৎ সৃষ্টির সময় গ্রহগুলোর অবশিষ্টাংশ। এরা পাথরের মতো কঠিন এবং আকারে একটি ছোট শহরের সমান হতে পারে, আবার গাড়ির আকারেরও হতে পারে।
এদের নিজস্ব কোনো বায়ুমণ্ডল নেই এবং এদের বেশিরভাগ মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে ‘গ্রহাণু বলয়ে’ (Asteroid Belt) ঘুরে বেড়ায়।
এখানে এদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং ভেঙে ছোট ছোট অংশে পরিণত হয়।
ধূমকেতু (Comet): ধূমকেতু তৈরি হয় বরফ, ধূলিকণা এবং পাথরের মিশ্রণে। সূর্যের চারদিকে এরা গ্রহের মতোই ঘোরে, তবে এদের কক্ষপথ অনেক বড় হওয়ায় একটি প্রদক্ষিণ করতে কয়েকশ’ বছর লেগে যায়।
সূর্যের কাছাকাছি আসার পর এদের বরফ বাষ্পীভূত হতে শুরু করে এবং এর ফলে এদের লেজ দেখা যায়, যা রাতের আকাশে এক অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এমন ধূমকেতুর সংখ্যা কয়েক বিলিয়ন হতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ হাজারের মতোকে চিহ্নিত করা গেছে।
উল্কা (Meteor) ও উল্কাপিন্ড (Meteoroid): মহাকাশে গ্রহাণু, ধূমকেতু, চাঁদ বা গ্রহাণুর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে যে ছোট ছোট কণা তৈরি হয়, তাদের উল্কাপিণ্ড বা ‘মেটিরিওয়েড’ (Meteoroid) বলে।
এই উল্কাপিণ্ড যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে। একেই আমরা ‘উল্কা’ (Meteor) বা ‘তারা খসা’ হিসেবে দেখি।
এদের মধ্যে যা আকারে বড়, তাদের ‘আগুনগোলক’ (Fireball) বা ‘বোলিড’ (Bolide) বলা হয়।
মহাকাশের পাথরের আঘাত:
যদি কোনো মহাকাশীয় বস্তু পৃথিবীর বুকে এসে আঘাত হানে, তবে কী হবে?
আসলে, গ্রহাণু বা উল্কাপিন্ডের আঘাত সিনেমার গল্পের মতো হলেও, এর বাস্তব উদাহরণও রয়েছে। তবে, সব আঘাতই যে ধ্বংসাত্মক হবে, তা নয়।
এর প্রভাব নির্ভর করে বস্তুটি কতটা বড়, তার গতি কেমন ছিল, ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।
ছোট আকারের উল্কাপিণ্ডগুলো বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পরেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং কোনো ক্ষতি করে না। আবার, কিছু বড় আকারের বস্তু বায়ুমণ্ডলে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না হয়ে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে, যা ‘উল্কাপিন্ড’ (Meteorite) নামে পরিচিত।
এদের পতনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বিশাল গর্ত তৈরি হয়। যেমন – ভারতের মহারাষ্ট্রের ‘লোনার ক্রেটার’ (Lonar Crater)।
তবে, বড় আকারের কোনো গ্রহাণু আঘাত হানলে তা খুবই ভয়ংকর হতে পারে।
একটি বাড়ির সমান আকারের গ্রহাণু আঘাত হানলে পারমাণবিক বোমার মতো ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে। এমনকি, এর আঘাতে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ মাসের পর মাস সূর্যের আলো আটকাতে পারে, যার ফলে পৃথিবীতে দীর্ঘমেয়াদি শীত দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে একটি গ্রহাণুর আঘাতের ফলেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
ধূমকেতু যেহেতু বরফ দিয়ে তৈরি, তাই এদের আঘাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা বেশি।
এর প্রভাবে পৃথিবীর ভূত্বক এবং সমুদ্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, যার ফলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিশাল জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।
মহাকাশ থেকে আসা বিপদ থেকে বাঁচতে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
এই ধরনের বিপর্যয় থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে, মহাকাশ থেকে আসা কোনো বিপদ থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালে, নাসার (NASA) ‘ডাবল অ্যাস্টরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট’ (DART) মিশন সফলভাবে একটি গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে।
এর মাধ্যমে, কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসলে, তার গতিপথ পরিবর্তন করে আমাদের গ্রহকে বাঁচানো সম্ভব।
ভবিষ্যতে এমন কোনো বিপদ থেকে বাঁচতে হলে, আমাদের মহাকাশীয় বস্তুগুলোর ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বিজ্ঞানীরা সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন।
বর্তমানে, আপনি নিশ্চিন্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন। কারণ, বিজ্ঞানীরা মহাকাশের বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার