আউশভিৎজে চলচ্চিত্র নির্মাণ: আসছে ডিজিটাল যুগ?

আউশউইৎজ-এর স্মৃতিবিজড়িত স্থানে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের (জার্মান ফ্যাসিস্ট) হাতে নিহত হওয়া প্রায় ১১ লক্ষ মানুষের স্মৃতিবিজড়িত এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের (বন্দিশ শিবির) একটি ‘ঐতিহাসিক ভাবে সঠিক’ ডিজিটাল প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছে।

এর ফলে চলচ্চিত্র নির্মাতারা আসল স্থানে না গিয়েও, এই বিভীষিকাময় স্থানে তাদের সিনেমার দৃশ্য ধারণ করতে পারবেন।

আউশউইৎজ-বিরকেনাউ মেমোরিয়ালের পক্ষ থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে (Cannes Film Festival) এই প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়। নির্মাতারা অত্যাধুনিক ত্রিমাত্রিক স্ক্যানিং প্রযুক্তির (3D scanning technology) মাধ্যমে এই ডিজিটাল মডেলটি তৈরি করেছেন।

বর্তমানে বিদ্যমান ক্যাম্পের প্রতিটি ইটের বুননও হুবহু ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই মডেলে।

প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে বিরকেনাউ (Birkenau) স্থানটির ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করা হবে। আউশউইৎজের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বড় এই স্থানটিতে নাৎসিদের ধ্বংস করা গ্যাস চেম্বার ও শ্মশানগুলির (Crematorium) ডিজিটাল প্রতিরূপও তৈরি করা হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১.৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ হবে।

আউশউইৎজ-বিরকেনাউ মেমোরিয়ালের পরিচালক ওজিয়েচ সোজেভিকা (Wojciech Soczewica) জানান, বর্তমানে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষের মধ্যে আউশউইৎজ ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ছে।

তাই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য নির্ভরযোগ্য উপাদান সরবরাহ করা তাদের দায়িত্ব। তবে, এই ডিজিটাল মডেল ব্যবহারের নিয়মাবলী এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

প্রাপ্ত ফি স্মৃতিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হবে, যা গণহত্যার শিকার হওয়া মানুষদের স্মরণে সহায়তা করবে।

আগে, আউশউইৎজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে শুধুমাত্র প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অনুমতি ছিল। ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ফিচার ফিল্ম নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

১৯৬৩ সালে ‘প্যাসেঞ্জার’ (Passenger) নামক একটি পোলিশ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের অনুমতি পাওয়া গেলেও, পরবর্তীতে স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ (Schindler’s List) -এর মতো চলচ্চিত্রে আউশউইৎজের ভেতরের দৃশ্য ধারণের অনুমতি মেলেনি।

ইতালীয় পরিচালক রবার্তো বেনিগনির ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ (Life is Beautiful) সিনেমাটির কিছু অংশ ইতালির পাপিগনো-র একটি পরিত্যক্ত কারখানায় এবং হাঙ্গেরীয় পরিচালক লাসলো নেমেসের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘সন অফ সল’ (Son of Saul) বুদাপেস্টের বাইরে চিত্রায়িত করা হয়।

আউশউইৎজ-বিরকেনাউ কর্তৃপক্ষের মতে, স্থানটির পবিত্রতা রক্ষা এবং ভিড় এড়ানোর জন্যই মূলত ফিচার ফিল্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

তবে, অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পী মনে করেন, আউশউইৎজের মতো স্থানে সিনেমা তৈরি করা নৈতিকভাবে সঠিক নয়।

উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়ান পরিচালক মাইকেল হানেকের মতে, ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর মতো সিনেমা, যেখানে গ্যাস নাকি জল আসবে, তা নিয়ে সাসপেন্স তৈরি করা হয়েছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

২০২৩ সালের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘দ্য জোন অফ ইন্টারেস্ট’ (The Zone of Interest) ক্যাম্পের কাছাকাছি স্থানে চিত্রায়িত হলেও, ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা জোনাথন গ্লেজার (Jonathan Glazer) ক্যামেরাকে কখনও এর দেওয়ালের উপর দিয়ে যেতে দেননি, যা ছিল তার শৈল্পিক এবং নৈতিক অবস্থান।

আউশউইৎজের মুখপাত্র পাওয়েল সাউইকি (Pawel Sawicki) জানান, চলচ্চিত্র প্রকল্পের প্রস্তাব মূল্যায়ন করার সময় তারা ঐতিহাসিক নির্ভুলতাকে সবার উপরে গুরুত্ব দেন।

অর্থাৎ, আউশউইৎজে যা ঘটেছিল বা ঐতিহাসিক দলিল ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যা ঘটা সম্ভব ছিল, সে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে।

তবে, কোন ধরনের সিনেমা এই ডিজিটাল মডেল ব্যবহার করতে পারবে, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

ইতিহাস বিকৃত করে অথবা গণহত্যার শিকার হওয়াদের স্মৃতির প্রতি অসম্মান জানিয়ে তৈরি হওয়া কোনো সিনেমাকে অনুমোদন দেওয়া হবে না।

এই প্রকল্পের পরামর্শদাতাদের মধ্যে রয়েছেন, ৮৬ বছর বয়সী রিশার্ড হোরোভিজ (Ryszard Horowitz)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৫ বছর বয়সে তিনি আউশউইৎজে বন্দী ছিলেন।

পরে অস্কার শিন্ডলারের (Oskar Schindler) সহায়তায় তিনি প্রাণে বাঁচেন। রিশার্ড হোরোভিজ বলেন, এই ঘটনাগুলো মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন এবং তিনি বিষয়টির যথার্থতার পক্ষে।

আউশউইৎজ-এর এই ডিজিটাল মডেল নির্মাণে যুক্ত রয়েছেন পোলিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা অ্যাগ্নিয়েস্কা হল্যান্ড (Agnieszka Holland)। তার মতে, নতুন প্রজন্মের কাছে ইউরোপের ইতিহাসের এই ভয়াবহ অধ্যায় তুলে ধরার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য এই স্থান উন্মুক্ত করা জরুরি।

তিনি আরও যোগ করেন, “দীর্ঘকাল ধরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের (গণহত্যা) ভয়াবহতা একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করেছে, যা ইউরোপীয় পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে।

তবে হলোকাস্টের প্রভাব এখন কমে গেছে এবং আমরা ৯০ বছর আগের মতোই একটি বিপদজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন।”

তথ্য সূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *